269583

মাত্র ১২ নারী নিয়ে যাত্রা শুরু, বাকিটা ইতিহাস

নিজস্ব ঐতিহ্য ও গৌরবে অনন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষা, গবেষণা ও জাতীয়ভাবে অবদানের ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রথম স্থান দখল করে রয়েছে।

ইতিহাস ঐতিহ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বের যে কোনো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অনন্য। কারণ পৃথিবীর বুকে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় আর খুঁজে পাওয়া যায় না, যেটি তার জাতিকে একটি নিজস্ব ভাষা ও মানচিত্র উপহার দিতে পেরেছে।

রোকেয়া হল মাত্র ১২ জন নারীকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আবাসিক নারী শিক্ষার্থী হল হলো রোকেয়া হল। চামেলি হাউজে মাত্র এই কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী নিয়ে ১৯৩৮ সালে যাত্রা শুরু করে রোকেয়া হলের।

রোকেয়া হল

রোকেয়া হল

১৯৬৪ সালে এর নামকরণ করা হয় ‘রোকেয়া হল’ নামে। মূলত বেগম রোকেয়া ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত। মিসেস আক্তার ইমাম ছিলেন এই হলের প্রথম প্রভোস্ট।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা ও দালালদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তৎকালীন আবাসিক ছাত্রীরা। বাংলাদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে রোকেয়া হলের ছাত্রীরা সক্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে সাহসী ভূমিকা পালন করেছে।

২০১৬ সালের ৭ মার্চ ভবনটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। বর্তমান প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জিনাত হুদার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালে ভবনটি উদ্বোধনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ স্মরণে নির্মিত ১০০৮ আসন বিশিষ্ট এ আধুনিক ভবনটির উদ্বোধন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর।

বর্তমানে এই ছাত্রী হলে তিন হাজারেরও বেশি ছাত্রীর আবাস। স্নাতক সম্মান শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে চারটি ভবন- শাপলা (প্রধান), চামেলি (নতুন), সূর্যমুখী (বর্ধিত) এবং ৭মার্চ ভবন। স্নাতকোত্তর এবং এমফিল শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে একটি ভবন- ফয়জুন্নেসা ভবন।

বর্তমান রোকেয়া হল

বর্তমান রোকেয়া হল

রোকেয়া হলের এ চারটি ভবনে কক্ষ সংখ্যা মোট ৫২০টি এবং আবাসিক ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৩০০০। রোকেয়া হলের সাথে সংযুক্ত ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৭০০০।

এছাড়া হল সংলগ্ন স্থানেই রয়েছে প্রভোস্ট বাংলো এবং আবাসিক শিক্ষিকাদের বাসভবন। প্রতিবছর মেধাবী শিক্ষার্থীদের রোকেয়া হল কর্তৃপক্ষ ‘রোকেয়া স্বর্ণপদক’ প্রদান করেন।

রোকেয়া হল ও ২৫ মার্চ কালো রাত

ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির নেত্রী ছিলেন ফরিদা খানম সাকী। মার্চের শুরুতে রোকেয়া হলের ছাত্রীরা হল ছাড়লেও ২৫ মার্চ পর্যন্ত ৬ জন ছাত্রী হলেই ছিলেন।

নেতারা ২৬-২৭ তারিখে হল ছাড়তে বলেছিলেন ছাত্রীদের। কালো রাতের ঠিক ১১টার দিকে হঠাৎ দূর থেকে অনেক গুলির শব্দ শুনতে পায় হলের ছাত্রীরা। গুলির আওয়াজ শুনতে না শুনতেই তারা দেখে পুরো এলাকায় সার্চ লাইটের আলো।

বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য

বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য

এরপর সেখান থেকে বাকী ছাত্রীরা প্রভোস্টের বাসার দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। তখন ঘটনাস্থলে থাকা এক নারীর গণমা্যেমে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, আমরা শব্দ শুনে বুঝছিলাম হলে প্রচুর আর্মি ঢুকছে। এরপর আমাদের কান্না শুনে আমাদের হাউস টিউটর সাহেরা আপা আমাদের নিয়ে স্টোররুমে লুকিয়ে রাখেন।

অল্পের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা জানিয়ে সাহসী ওই নারী বলেন, মিলিটারিরা সাহেরা আপার কোয়ার্টারেও চলে আসে এবং মেয়ে বের করে দিতে বার বার তাগাদা শুরু করে। কারণ পাকিস্তানি আর্মির ধারণা ছিলো এই হলে তখনো প্রচুর ছাত্রীরা রয়ে গেছে।

এরকম আতংকের মধ্যে রাতটি পার করে ছাত্রীরা। সাহেরা ম্যাডামের বাসা থেকে ২৬ তারিখে মেহেরুন্নেসা ম্যাডামের বাসায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি চেয়েছিলেন এলিফ্যান্ট রোডে তার এক বোনের বাসায় আমাদের রেখে আসবেন।

কালো রাতের সাক্ষী বেগম রোকেয়া হল

কালো রাতের সাক্ষী বেগম রোকেয়া হল

তবে ২৭ তারিখ কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ তুলে নেয়ার ঘোষণার পর হল গেইটে আমাদের কয়েকজন নেতৃবৃন্দ আমাদের অবস্থা জানতে আসেন। তাদের কাছেই জানলাম সমস্ত হলে ম্যাসাকার হয়েছে। সেদিনই ওয়ারিতে আমি আমার একজন আত্মীয়ের বাসা থেকে পরে গ্রামের বাড়িতে চলে যাই।

হাউস টিউটর ও সেদিন বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী রোকেয়া হলে পাকিস্তানি সেনাদের চালানো গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে কোন ছাত্রী ছিলেন না।

তবে বেঁচে যাওয়া এস.এম মহসীনের নিজ চোখে দেখা বর্ণনা এবং অধ্যাপক রওশন আরা ও তৎকালীন ছাত্রী ফরিদার বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট যে একরাতে কসাইখানায় পরিণত হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী-শিশু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ক্ষেত্র ছিলো রোকেয়া হল।

আজ থেকে ঠিক ৪৮ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল প্রাঙ্গণে উন্মোচিত হয়েছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্মমতার আরো একটি নিদর্শন। সেদিন সোমবার ২৪ এপ্রিল ১৯৭২ সাল। রোকেয়া হলের গণকবর খুঁড়ে ১৫টি মাথার খুলিসহ প্রচুর হাড় উদ্ধার করা হয়েছিল।

রোকেয়া হলের গণকবর

রোকেয়া হলের গণকবর

পাকিস্তানী নরপশুদের নৃশংস গণহত্যার শিকার শহীদদের দেহাবশেষ পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে সমাধি দেয়া হয়।

এই গণকবর থেকে সেদিন একটি ঘড়ি ও কয়েক গাছি চুড়ি পাওয়া যায়। ঘড়িটি নাসিরউদ্দিন নামে এক ব্যক্তির বলে জানা যায়। তার ভাই গিয়াসউদ্দিন রোকেয়া হলের কর্মচারী ছিলেন। আরেক কর্মচারী আলী আক্কাসের মেয়ে রাশিদার কিছু চুড়ি পাওয়া যায়।

এখানেই নমী রায়ের (কর্মচারী) ভাইয়ের স্ত্রী’র চুড়ি পাওয়া গেছে। নমী রায় এবং তার পরিবারের ৭ জন সদস্য ২৫শে মার্চ একাত্তরের কালরাতে রাতে শহীদ হন। উল্লেখ্য যে, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কোয়ার্টারের প্রতিটি বাসায় হানা দিয়েছিল পাকিস্তানী জল্লাদরা।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.