269276

ভারতের সীমান্তে নগ্ন এক আদিবাসী, এরা কারা?

নানা কারণে আফ্রিকানরা বিতর্কিত। দাসত্ব, বর্ণবাদ, হিংস্রতা, কুসংস্কারসহ আরো অনেক কারণে বিশ্বের মানুষের কাছে তারা পরিচিত। গহীন জঙ্গলের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে একদল মানুষের বাদ্যের তালে তালে উদ্দ্যাম নৃত্য। আফ্রিকানদের কথা শুনলে চোখে ভেসে ওঠে, গাছের ছাল- বাকল আর পশুর চামড়ায় ঢাকা অর্ধনগ্ন কিছু মানুষ। কেউবা পুরো নগ্ন, সামান্য লজ্জা নিবারণের বালাই নেই তাদের।

এমনই কিছু মানুষের বাস ভারতে। অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়? হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। কালো মানুষদের একটি জাতি এখনো বাস করে ভারতের জঙ্গলে। তবে তারা আধুনিক সমাজ থেকে এখনো পিছিয়ে। তাদের চেহারা ভারতীয়দের মতো নয়। ভারত তাদের স্বদেশও নয়। তাদের দেশ আফ্রিকার ইথিওপিয়া। জানেন কি? এদের পূর্বপুরুষ কিন্তু ভারতের উৎকর্ষে রেখেছে অনেক অবদান। বহুকাল ভারত শাসন করেছেন আফ্রিকান রাজারা। পৃথিবীর মহিমামণ্ডিত কিছু সভ্যতা যে কালো মানুষেরাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটা তাদের উত্তরসূরিদের দুর্দশা দেখে আজ প্রায় ভুলতেই বসেছে মানুষ।

রাজা মালিক আনদিল খান সুলতান হাবসি বংশ প্রতিষ্ঠাকারী

রাজা মালিক আনদিল খান সুলতান হাবসি বংশ প্রতিষ্ঠাকারী

প্রাচীন গ্রীস বা রোমের হাজার বছর আগে কালো চামড়ার কর্মঠ দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষরা এই অঞ্চলে শক্তিশালী সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন সিন্ধু উপত্যকায়। অনেক নৃতাত্ত্বিকের ধারণা, দ্রাবিড়দের পুর্বপুরুষ ছিলেন কালো আফ্রিকানরাই। ইথিওপীয়দের সঙ্গে (প্রাচীন) ভারতীয়দের খুব আত্মিক সম্পর্ক ছিল। ইতিহাস বিস্মৃত সুপ্রাচীনকালে ইথিওপীয়রা ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল শাসন করেছেন। এসব ইথিওপীয়দের নাগা নামে ডাকা হতো। নাগাদের হাতেই সংস্কৃত ভাষার জন্ম। নাগারা ছিলেন সামুদ্রিক অভিযাত্রী গোষ্ঠী ও দক্ষ নাবিক। তারা শুধু মধ্য ভারত নয়, বরং শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারেও নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

ভারতে বসবাসকারী এই জাতিকে ডাকা হয় হাবসি নামে। ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা জয় করেন বাংলা শাসন করা প্রথম আফ্রিকান রাজা মালিক আনদিল খান সুলতান। তিনিই এই হাবসি বংশ প্রতিষ্ঠাকারী। তবে অ্যাবিসিনিয়ার (ইথিওপিয়া) লোকেদের হাবসিই বলা হত। ভারতে হাবসিরা এসেছি্লেন মূলত ক্রীতদাস হয়ে। আরবের দাস ব্যবসায়ীরা হাবসিদের ভারতে পাচার করতে শুরু করেছিল। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে, হাবসি ক্রীতদাসদের নিয়ে প্রথম জাহাজটি গুজরাটের ভারুচ বন্দরে নোঙর ফেলেছিল। এর পরে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে, উমিয়াদ খিলাফতের সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাশিম, তার হাবসি সেনা নিয়ে ভারতে এসেছিলেন। হাবসি নামটি শুনে ভাবছেন ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা কীভাবে এই জাতির নামকরণ করলেন। আসলে ভারতে আসার পরই তাদের এই নাম হয়। আর সেটি দেন রাজা মালিক আনদিল খান সুলতান। তাও তিনি রাজা হওয়ার পরে।

রঙচঙে ছিটকাপড়ের পোশাক পরেন নারীরা

রঙচঙে ছিটকাপড়ের পোশাক পরেন নারীরা

একসময় আরবদের হাত থেকে দাস ব্যবসা ছিনিয়ে নেয় পর্তুগিজেরা। হাজার হাজার হাবসিকে পর্তুগিজ জাহাজে করে নিয়ে আসা হয় ভারতে। দাসেদের মধ্যে কেউ কেউ সমুদের ঝাঁপ দিয়ে সলিল সমাধি দিয়েছেন। আবার অনেকে পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় না পেয়ে মাঝপথেই প্রাণ হারাত।  আতঙ্কে কেউ কেউ হারিয়ে ফেলত মানসিক সুস্থতা। পর্তুগিজ দাস ব্যবসায়ীরা সুস্থ হাবসিদের খোলা বাজারে বিক্রি করত। শক্তিশালী চেহারার হাবসিদের দিয়ে মালিকেরা করাত পরিশ্রমসাধ্য কাজ। পর্তুগিজদের দেখাদেখি আফ্রিকা থেকে হাবসিদের তুলে এনে বিক্রি করতে শুরু করেছিল ডাচ, ফরাসি ও ইংরেজ দাস ব্যবসায়ীরাও।

ভারত শাসন করা আরেক আফ্রিকান রাজা জামাল আল-দ্বীন ইয়াকুতও ছিলেন একজন দাস। তবে রাজা মালিক আনদিল খান সুলতান ছিলেন সিদি আফ্রিকীয়। পরবর্তিতে হাবসিদের নাম হয়ে যায়‘সিদ্দি’। সিদি থেকে সিদ্দি।  সিদি হচ্ছে সিদ্ধি শব্দের প্রচলিত অপভ্রংশ। সোয়াহিলি ভাষার মূল শব্দটি হলো শিদি বা হাবশি। আজো এদের বংশধরেরা ভারত ও পাকিস্তানের নানা অঞ্চলে বসবাস করেন। পূর্ব আফ্রিকার বান্টু জনগোষ্ঠীরাই হাবশিদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বলে অনুমান করা হয়।

সিদ্দিদের গ্রাম ভারতের অন্য গ্রামগুলোর মতোই দেখতে

সিদ্দিদের গ্রাম ভারতের অন্য গ্রামগুলোর মতোই দেখতে

ঊনবিংশ শতাব্দীতে দাসপ্রথা অবলুপ্ত হয়ে যায়। সেসময় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় দাস হিসেবে থাকা হাবসিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। সঙ্গে করে পরিবার পরিজন সবকিছুই নেয়। পাছে কিনা মালিকেরা আবার ধরে ফেলে এই ভয়ে। আবার পায়ে দাসত্বের বেড়ি পরায়। হাবসিদের কোনো গোষ্ঠী লুকিয়ে পড়েছিল গুজরাটের জঙ্গলে। কোনো গোষ্ঠী আবার পালিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের সিন্ধপ্রদেশে। কোনোটা আবার পশ্চিমঘাট পর্বতমালার দুর্গম পাহাড়ি পথ দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল কর্নাটকের ‘উত্তর কান্নাড়’ জেলায়।

দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তি পাওয়া হাবসিদের নিজেদের এলাকায় দেখে স্থানীয় ভারতীয়রা প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু বুকে টেনেও নেননি। শত শত বছর ধরে প্রতিবেশী অবে আপন হতে পারেনি ভারতীয়দের। হয়তো তাদের চেহারার জন্যেই। আজ ভারতে বাস করেন প্রায় সত্তর হাজার হাবসি। তবে তারা হাবসি শব্দটির কালিমা নিজেদের জীবন থেকে আড়াল করতেই নিজেদের পরিচয় দেন সিদ্দি। ইথিওপিয় ভাষায় যা একটি সম্মানসূচক শব্দ।

অতিথি আপ্যায়নে তারা অতুলনীয়

অতিথি আপ্যায়নে তারা অতুলনীয়

পর্তুগিজদের প্রভাবে ভারতীয় সিদ্দিরা মূলত খ্রিস্টান। তবে মুসলিম ও হিন্দু সিদ্দিও দেখতে পাওয়া যায়। সিদ্দিদের পদবি সিদ্দিই। ধর্ম অনুযায়ী শুধু পালটে যায় নাম। যেমন কৃষ্ণা সিদ্দি, ইমাম সিদ্দি, বাস্তিয়ান সিদ্দি। সিদ্দিরা মূলত কোঙ্কোনি ভাষায় কথা বলেন। তবে কোনো কোনো গোষ্ঠী বলেন গুজরাটি, কন্নড় ও মারাঠি। সিদ্দিরা ভুলে গিয়েছেন তাদের মাতৃভাষা ‘অ্যামহারিক’।  ধর্ম, সংস্কৃতিতে বদল এলেও দু’টি অভ্যাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সিদ্দিদের একসুতোয় বেঁধে রেখেছে। প্রথমটি হলো পূর্ব পুরুষদের আত্মার উপাসনা পদ্ধতি ‘হিরিয়ারু’ এবং দ্বিতীয়টি হল আফ্রিকার ছন্দ ও তালে গাঁথা এক নৃত্যশৈলী ‘গোমা’। যা সোয়াহিলি শব্দ ‘এনগোমা’ থেকে এসেছে।

২০০৩ সালে শিডিউলড ট্রাইব তালিকায় সিদ্দিদের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, ভারতে আজো সিদ্দিরা সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই হয়তো আজো শারীরিক গঠনে তারা আফ্রিকার বৈশিষ্ট্যগুলো ধরে রাখতে পেরেছে। কারণ সিদ্দিদের বিয়ে হয় কেবলমাত্র সিদ্দি গোষ্ঠীর  মধ্যেই।গুজরাটে আছে সাসান গির অরণ্যের প্রান্তে আছে সিদ্দিদের গ্রাম জাম্বুর। অনেকে এটিকে গির অরণ্য নামেও চেনেন। ১৪২২ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা গির অরণ্যে বাস করে এশিয়াটিক লায়ন, ভারতীয় চিতাবাঘ, বন বিড়াল, হায়না, সোনালি শিয়াল, বেজি, চিতল, নীলগাই, অ্যান্টিলোপ, চিঙ্কারা, বুনোশুয়োর, ব্ল্যাক বাক, সজারু, খরগোশ, প্যাঙ্গোলিন ও আরও কত শত জীবজন্তু এবং তিনশো প্রজাতির পাখি। তাদের সঙ্গেই নিজেদের মানিয়ে নিয়ে জাম্বুর গ্রামে থাকছে সিদ্দিরা।

হাজার বছর পেরুলেও ভারতীয়রা তাদের আপন করেনি

হাজার বছর পেরুলেও ভারতীয়রা তাদের আপন করেনি

গ্রামের রাস্তাঘাট কিংবা বাড়িঘর সবকিছু দেখে আপনার মনে হবে ভারতের আর দশটা গ্রামের মতোই। তবে গ্রামে ঢোকার পর এর পরিবেশ দ্রুত বদলাতে শুরু করবে। গ্রামের মানুষদের দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন আপনি। এদের বাদামি রঙের কোঁকড়া চুল, চওড়া চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট, মিশকালো ত্বক, শিশু কন্যাদের মাথাভরা ছোটো ছো্টো বিনুনি, তাতে গাঁথা রঙিন পুঁতি, রঙচঙে ছিটকাপড়ের পোশাক। সবকিছুই তাদের ভারতীয়দের থেকে আলাদা করেছে। সিদ্দিরা এখানে আসা অতিথিদের উষ্ণ আমন্ত্রণ জানাতে ভোলেন না। কোনো বাড়ির বারান্দায় অতিথিকে নিয়ে বসে পড়বেন গ্রামের মধ্যবয়স্ক সিদ্দিরা। শোনাবেন তাদের অতীত। যা তারা বংশপরম্পরায় শুনে এসেছেন। আপ্যায়নে কোনো কমতি রাখবে না তারা। নিজেরা যা খান তাই খেতে দেবেন। তবে বাড়িতে মুরগী বা মাছ রান্না হলে, সিদ্দিরা অতিথিদের প্লেটে তুলে দেবেন মুরগীর লেগ পিস কিংবা মাছের মাথা।

গ্রামে বাস করেন প্রায় পাঁচশো জন সিদ্দি। কৃষিকাজ আর জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করাই এই সিদ্দি পরিবারগুলোর পেশা। কেউ কেউ অবশ্য শ্রমিকের কাজও করেন। শহরে গিয়ে পড়াশোনা শেখা সিদ্দি যুবকেরা কাজের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন শহরে। শহর থেকেই পরিবারে টাকা পাঠান তারা। অর্থনৈতিক দিক থেকে দারিদ্রসীমার কাছাকাছি থাকলেও অন্তরের সম্পদে আজও সিদ্দিরা ধনী। ভারতের অনান্য সিদ্দি গোষ্ঠীগুলির মতো জাম্বুর গ্রামের সিদ্দিরাও আমিষাশী। মাংস মাছ ও ডিম খেতে ভালোবাসেন। কিন্তু উৎসব ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া মাংস খাওয়ার সামর্থ্য সবার হয় না। তবে সিদ্দিদের যেকোনও বড় উৎসবে ভেড়া, ছাগল বা মুরগির মাংস থাকবেই।

চলে তাদের ধামাল নাচ

চলে তাদের ধামাল নাচ

শত শত বছর আগে ছেড়ে আসা সুদূর আফ্রিকার ঐতিহ্য বহন করছে তারা এখনো। অতিথির আগমনে গ্রামের মাঝে আগুন জ্বালাবেন গ্রামের যুবক যুবতীরা। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে আগুন। সশব্দে ফাটতে থাকবে আগুনলাগা কাঠ। শূন্যে উড়বে লালচে স্ফুলিঙ্গ। আগুনকে ঘিরে শুরু হবে সিদ্দি যুবক যুবতীদের ‘ধামাল’ নাচ। চড়া ও অচেনা তালে বাজবে ভারতীয় ঢোল। রুক্ষ জমিতে তালে তালে পড়তে থাকবে কয়েক ডজন পা। এ নৃত্যশৈলী ভারতের নয়। নর্তক নর্তকীদের শরীরী বিভঙ্গে ভারতের বুকে অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে জেগে উঠবে আফ্রিকা। আগুনের আভায় লাল হয়ে যাওয়া শরীরগুলো তৈরি করবে এক প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশ। তবে এরসঙ্গে আপনার জন্য থাকবে ধুমায়িত চা আর বেসনের পকোড়া।

যে কেউ গিয়ে ঘুরে আসতে পারেন সিদ্দিদের গ্রামে। সাক্ষী হতে পারেন সুদূর আফ্রিকার একদল মানুষের সংস্কৃতির। গুজরাটের গির অরণ্য ভ্রমণে এসে মনের ডানা মেলে পৌঁছে যাবেন আফ্রিকার মাহালে, সেরেঙ্গেটি, রুয়াহা ন্যাশনাল পার্কের পাশে থাকা আদিবাসী গ্রামে। অন্যদিকে শত শত বছর আগে আফ্রিকা ছেড়ে আসা মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাসও শুনতে পাবেন বাতাসে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.