268891

৩০ টাকার মাস্ক তিন টাকা, তবু ক্রেতা সংকট!

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও তাতে মানুষের মৃত্যু অব্যাহত থাকলেও স্বাস্থ্যবিধির অন্যতম অনুষঙ্গ মাস্কের চাহিদা কমে গেছে বিপুলভাবে। বর্তমানে যা কিছু চাহিদা তা সার্জিক্যাল মাস্কের। একসময় ৩০ টাকা বিকোনো এই মাস্ক এখন ৩ টাকায় হাঁকডাক করে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে পাঁচ টাকার প্রচলিত সাধারণ মাস্ক ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হয়। পরে নানা ব্রান্ডের মাস্ক বাজারে এলেও তার দাম ছিল আকাশ ছোঁয়া। লকডাউনের পর সীমিত পরিসরে সবকিছু চালু হলে মাস্কের বিপুল চাহিদার কারণে ফুটপাত, বাজার, ফার্মেসি, মুদি দোকান ও অনলাইনে সয়লাব হয়ে যায় নানা ধরনের মাস্কে। যেকোনো দামে দেদার বিকিয়েছে সার্জিক্যাল, এন-৯৫, কেএন-৯৫ মাস্ক। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠে মাস্ক তৈরির কারখানা।

মাস্কের চাহিদা যখন তুঙ্গে তখন হাসপাতালে ব্যবহৃত পুরনো মাস্ক ধুয়ে তা পুনরায় বিক্রির নজির আছে। এ ধরনের এক চক্রকে গ্রেপ্তার করেছিল র‍্যাব। এছাড়া নকল মাস্ক তৈরির একাধিক কারখানাও পাওয়া গেছে রাজধানীতে। অবৈধভাবে মানহীন মাস্ক উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিক্রি হয়েছে দেদার।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক ব্যবহারের আগ্রহ আশংকাজনকভাবে কমেছে। এন-৯৫ বা কেএন-৯৫ মাস্কের চাহিদা বর্তমানে ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে বলে জানান বিক্রেতারা। সার্জিক্যাল মাস্কের দাম সুলভ হলেও এর চাহিদাও কমছে দিন দিন। ফলে উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছেন কারখানা মালিকরা। দোকানিরা এখন আর বাড়তি মাস্ক মজুদ রাখেন না।

ধানমন্ডি, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সড়কের পাশেই বসেছে মাস্ক বিক্রির দোকান। অস্থায়ী এসব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে সব ধরনের মাস্ক। সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৫ টাকায়। অথচ করোনা কালের শুরুর দিকে দেশে মাস্ক নিয়ে যখন যাচ্ছেতাই অবস্থা, তখন গত ১১ মার্চ সার্জিক্যাল মাস্কের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। তিন স্তর বিশিষ্ট একেকটি সার্জিক্যাল মাস্কের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩০ টাকা। এরপর তা ২০ টাকা, ১৫ টাকা এবং ১০ টাকায় নেমে আসে।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মাস্ক তৈরির কারখানা গড়ে ওঠায় দাম কমে আসে সার্জিক্যাল মাস্কের। বর্তমানে খোলা বাজারে প্রতিটি সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৫ টাকায়। আর পাইকারি বাজারে ২ থেকে ৩ টাকায় মিলছে প্রতিটি মাস্ক।

একই ভাবে কমেছে ফিল্টারযুক্ত কাপড়ের মাস্কের দাম। বর্তমানে ১০ থেকে ১৫ টাকায় মিলছে এসব মাস্ক। চাহিদা না থাকায় কমে এসেছে কেএন-৯৫ মাস্কের দাম। খুচরা বাজারে ৪০-৫০ টাকা এবং পাইকারি বাজারে ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এসব মাস্ক।

অস্থায়ী দোকানের মতো রাজধানীতে মাস্ক বিক্রি করছেন ভ্রাম্যমাণ হকাররাও। একই মাস্ক বিক্রি হচ্ছে মুদির দোকানে। ফার্মেসিগুলোতে উন্নত ও নিম্ন সব মানের মাস্কই পাওয়া যাচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনেও।

পর্যাপ্ত জোগান ও দাম কম হলেও মাস্কের বিক্রির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে বলে জানিয়েছে নগরির পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড ও আনন্দ সিনেমা হল এলাকায় মাস্ক বিক্রির অর্ধশতাধিক অস্থায়ী দোকান রয়েছে। এসব দোকানে প্রতিটি সার্জিক্যাল মাস্ক ৫ টাকা আর এক বাক্স মাস্কের দাম ১৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বক্সে রয়েছে ৫০টি করে মাস্ক। একটি মাস্কের দাম পড়ছে মাত্র ৩ টাকা।

ফার্মগেট এলাকার মাস্ক বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ’২০-৩০ টাকা করে যখন মাস্ক বিক্রি করতাম, তখন দৈনিক ৩০০-৪০০ মাস্ক বিক্রি হইতো। এখন বিক্রি নাই বললেই চলে। সার্জিক্যাল মাস্ক কিছু চলে, তাও আগের চাইতে কম।‘

করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে বিপুল চাহিদার কারণে কেরানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়িতে গড়ে ওঠে সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরির কারখানা। এগুলোর বেশির ভাগই অনুমোদনহীন। অবশ্য কারখানা মালিকদের দাবি, অনুমোদন নিয়েই তারা মাস্ক উৎপাদন করছেন। তবে সূত্রমতে, অধিকাংশ কারখানাই চলছে অনুমোদনহীনভাবে।

রাজধানীর জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীরচর, সোয়ারিঘাট, লালবাগ, উত্তরখান, দক্ষিণখান, তুরাগ, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় মাস্ক তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে।

লকডাউনের পর সীমীত পরিসরে সবকিছু চালু হওয়ার পর মাস্কের চাহিদা বাড়লেও দিনে দিনে তা কমে আসে। এখন মাস্ক বিক্রেতারা হাঁকডাক করে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। খুব প্রয়োজন না হলে কেউ সেদিকে তাকায় না। ফলে কারখানায় মাস্কের চাহিদা কমে গেছে। দৈনিক কয়েক লাখ মাস্ক তৈরিতে সক্ষম প্রতিটি কারখানা এখন তাদের উৎপাদন কমানোর পথে। উৎপাদকদের দাবি, পাইকাররা আগের চেয়ে অনেক কমওমাল চাচ্ছেন।

সিরাজ উদ্দিন নামের একজন মাস্ক উৎপাদক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শুরুর দিকে মাস্ক ব্যবহারে মানুষের অনেক সচেতনতা ছিল। সবাই মাস্ক পরত। এখন আর পরে না। তাই চাহিদা কম। খুচরা ব্যবসায়ীরাও বিক্রি করতে পারে না বলে পাইকাররা সেভাবে অর্ডার পাচ্ছে না। আর পাইকাররা অর্ডার কম পেলে আমরা কার জন্য বানাব? তাই উৎপাদন কমিয়ে দিতে হয়েছে আমাদের।’

উৎপাদকরা জানান, কিছুদিনের ব্যবধানে মাস্কের চাহিদা ১০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। বাধ্য হয়ে দাম কমিয়েছেন উৎপাদকরা। পাইকার, মজুদদার এবং খুচরা ব্যবসায়ীরা মুনাফা কম নিয়েও বিক্রি করতে পারছেন না মজুদ করা মাস্ক।

মাস্কে অনাগ্রহ, নকল মাস্ক, আর স্বাস্থ্যঝুঁকি

এদিকে বাজারে বিক্রি হওয়া কেএন-৯৫ মাস্ক আমদানি করা বলে দাবি করা হলেও এর বেশির ভাগ তৈরি হচ্ছে দেশে। কোনো কোনো কারখানা আবার অনুমোদনহীন। সেখানে তৈরি হচ্ছে মানহীন মাস্ক। রাজধানীর পুরান ঢাকা, কেরানীগঞ্জ এবং সাভার এলাকায় উৎপাদন হচ্ছে এসব। কিন্তু বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে চীন থেকে আমদানি করা দাবি করে।

মানহীন মাস্ক মানুষের করোনা সংক্রমণ ঝুকি বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে তারা মানুষের মধ্যে মাস্ক পরায় অনাগ্রহের জন্য শঙ্কা প্রকাশ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজের সাবেক উপাচার্য এবং সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নজরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, মানুষ বলে জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। আবার এটাও দেখতে হবে, কোরআন-হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা আছে, কোনো স্থান বা সম্প্রদায়ের মধ্যে মহামারি দেখা দিলে যত দিন পর্যন্ত না ভালো হয়, ততদিন তোমরা এলাকার বাইরে যেয়ো না। কাজেই কোনো মহামারির সময় স্বাস্থ্যবিধি না মানার কোনো অজুহাত ঠিক না।

মাস্ক ব্যবহারে মানুষকে আরও সতর্ক হতে হবে এবং বাজারজাত করা মাস্কগুলোর মানের দিকে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে নজর দিতে হবে বলে মনে করছেন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিসের (এফডিএসআর) যুগ্ম মহাসচিব ডা. রাহাত আনোয়ার চৌধুরী।

ঢাকা টাইমসকে ডা. রাহাত আনোয়ার বলেন, ‘মাস্কের বিভিন্ন গ্রেডিং আছে। সার্জিক্যাল মাস্ক তিন স্তরবিশিষ্ট আদর্শ মাস্ক। আমাদের দেশে তো এগুলোর সার্টিফিকেশনের কোনো সুযোগ নাই। স্থানীয়ভাবে যেগুলো তৈরি হচ্ছে, এগুলো আদৌ কতটুকু সঠিক তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বলা দুষ্কর। আমরা জানি, এগুলো সার্টিফাইড না হলে হয় না।’

সমাধানের রাস্তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঔষধ প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে, এ সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করতে হবে। এটা যেহেতু সুরক্ষা সামগ্রী, এর সঙ্গে মানুষের জীবন-মৃত্যু জড়িত। অবশ্যই নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনেক বেশি সচেতন হওয়া উচিত।‘

নকল মাস্ক ও অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রীর বিষয়ে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের দৃষ্টি রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মীর সোহেল রানা। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘করোনা সংশ্লিষ্ট নকল মাস্ক ও অন্যান্য সামগ্রী যারা তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পুলিশের র‍্যাবসহ বিভিন্ন ইউনিট অভিযান পরিচালনা করেছে। উৎপাদনকারী এবং বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।

সাধারণ মানুষকে মাস্ক ব্যবহারে সচেতন করতে পুলিশ কাজ করছে জানিয়ে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘নানাভাবে, নানা উপায়ে মানুষকে মাস্ক ব্যবহারে আগ্রহী করে তুলছে পুলিশ। ভয় কিছুটা কমলেও করোনার ঝুঁকির বিষয়ে মানুষ এখন অনেক সচেতন।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.