268534

পাঁচ টাকার সেই ‘কুসুম্বা মসজিদ’ ঠাঁই দাঁড়িয়ে ৪৬২ বছর

কুসুম্বা মসজিদ। প্রায় ৪৬২ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ। নঁওগা শহর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার দূরে মান্দা উপজেলার কুসুম্বা গ্রামেই এই মসজিদের অবস্থান। মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন এই কুসুম্বা মসজিদ।

বর্তমানের পাঁচ টাকার নোটে আপনারা সবাই এই মসজিদটি দেখেছেন নিশ্চয়! রাজশাহী মহাসড়কের মান্দা ব্রিজের পশ্চিম দিকে ৪০০ মিটার উত্তরে কুসুম্বা মসজিদটি অবস্থিত। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন এই মসজিদটি দেখার জন্য।

মূল ফটকের বাইরে দাঁড়ালেই দেখা যায় ধূসর রঙা বিখ্যাত এই মসজিদটি। প্রবেশদ্বার সংলগ্ন সাইনবোর্ডেই মসজিদটির ইতিহাস সম্পর্কে লেখা রয়েছে। ১৫৫৮ থেকে ১৫৬৯ সালের মধ্যেই এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে সাইনবোর্ডে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আফগানি শাসনামলের শেষ দিকের শাসক গিয়াসউদ্দিন বাহদুর শাহ’র আমলে সুলাইমান নামের একজন এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।

কুসুম্বা মসজিদ

কুসুম্বা মসজিদ

কুসুম্বা মসজিদটি সুলতানি আমলের একটি পুরাকীর্তি। যা নওগাঁ জেলার ইতিহাস ও মুসলিম ঐতিহ্যের উজ্জ্বল নিদর্শন। মসজিদটি বাংলা চালা ঘরের মতো উত্তর-দক্ষিণে ঈষৎ বক্র। মসজিদ সংলগ্ন উত্তর-দক্ষিণ দিকে রয়েছে ৭৭ বিঘা বিশিষ্ট একটি বিশাল দিঘি। সেখানে রয়েছে সুন্দর শাঁন বাঁধানো ঘাট।

দিঘিটি লম্বায় প্রায় ১২০০ ফুট ও চওড়ায় প্রায় ৯০০ ফুট। গ্রামবাসী এবং মুসল্লিদের খাবার পানি, গোসল ও অযুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই দিঘিটি খনন করা হয়েছিল। এই দিঘির পাড়েই নির্মাণ করা হয়েছে ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ। বেড়াতে এসে দর্শণার্থীদের অনেকেই দিঘির টলটলে জলে গোসল সেরে নিতে ভুলেন না।

কুসুম্বা মসজিদের দৈর্ঘ্য ৫৮ ফুট, প্রস্থ ৪২ ফুট। দুই সারিতে ছয়টি গম্বুজ রয়েছে। চারদিকে প্রাচীর ঘেরা এই মসজিদটির মূল গাঁথুনি ইটের হলেও এর সম্পূর্ণ দেয়াল এবং ভেতরের খিলানগুলোও পাথরের আস্তরণে ঢাকা। মসজিদের গায়ে রয়েছে লতা-পাতা আঁকা নকশা। মসজিদের স্তম্ভ, ভিত্তি মঞ্চ, মেঝে, দেয়ালের গায়ের নকশা পর্যন্তও পাথরের।

ভেতরের দৃশ্য

ভেতরের দৃশ্য

চারদিকের দেয়াল ছয় ফুট পুরু। তার উপর বাইরের অংশ পাথর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে তিনটি দরজা। আকারে দুইটি বড়, অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট। দরজাগুলো খিলানযুক্ত মেহরাব আকৃতির। মসজিদের চার কোণায় রয়েছে চারটি মিনার। মিনারগুলো মসজিদের দেয়াল পর্যন্ত উঁচু ও আট কোণাকার। ছাদের ওপর রয়েছে মোট ছয়টি গুম্বুজ। যা দুইটি সারিতে তৈরি।

দ্বিতীয় সারির গম্বুজগুলো আকৃতির দিক দিয়ে ছোট। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে তিনটি গম্বুজ নষ্ট হয়েছিল। পরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি সংস্কার করে। মসজিদের ভেতর দুইটি পিলার রয়েছে। উত্তর দিকের মেহরাবের সামনে পাথরের পিলারের ওপর তৈরি করা হয়েছিল একটি দোতলা ঘর। এই ঘরটিকে বলা হতো জেনান গ্যালারি বা নারীদের নামাজের ঘর। এখানে নারীরা পৃথকভাবে নামাজ পড়তেন।

মসজিদের ভেতরের এক কোণে স্তম্ভের উপর একটি উঁচু আসন রয়েছে। ধারণা করা হয়, এই আসনে বসেই তৎকালীন কাজী বা বিচারকরা এলাকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে বিচারকাজ পরিচালনা করতেন। মুঘল সম্রাট আলাউদ্দিন হোসেন শাহ’র শাসনামলের কাজী এই আসনে বসেই বিচারকাজ করতেন। তার সামনে বাদী-বিবাদীরা বিচারকের সামনে মেঝেতে বসে থাকতেন। তখনকার সময় কোর্ট-কাচারি না থাকায় মসজিদে বসেই ইসলামিক নিয়মে বিচার করা হত।

মসজিদের ভেতরের বিচারকের আসন

মসজিদের ভেতরের বিচারকের আসন

মসজিদের ভেতর পশ্চিমের দেয়ালে রয়েছে তিনটি চমৎকার মেহরাবের ওপর ঝুলন্ত শিকল, ফুল ও লতা-পাতার কারুকাজ করা। এ কারুকার্যগুলো খুব উন্নত মানের। দক্ষিণ দিকের মেহরাব দুইটি আকারে বড়। উত্তর দিকের মেহরাবটি ছোট। মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণ দিকে দুইটি করে দরজা ছিল। মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ ও পাথর বসানো সিঁড়ি। যা দিঘিতে গিয়ে নেমেছে। মসজিদের প্রবেশ পথের ‌একটু দূরে বাক্স আকৃতির একখণ্ড কালো পাথর দেখা যায়। এটিকে অনেকে কবর বলে মনে করেন।

জানা যায়, এক কৃষক হাল চাষের সময় তার জমিতে পাথরটির সন্ধান পায়। এরপর পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়েছিল। এই পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবিতে লেখা রয়েছে, আল মালেকু মা হুমম মোকারারামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আসরাফ আল হোসেন। যার অর্থ তিনি শাসক পরাক্রমশালী ও সন্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হুসেনের পুত্র আবুল মোজাফর হোসেন শাহ। এর থেকে বোঝা যায় প্রস্তুর খণ্ডটি হুসেন শাহের স্মৃতি বিজড়িত।

পাথরের মসজিদ

পাথরের মসজিদ

ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী, সবরখান বা সুলাইমান নামে ধর্মান্তরিত এক মুসলমান মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের দুটি শিলালিপির প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তবে মূল প্রবেশ পথের শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় এই মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি বা ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দের। শের শাহের বংশধর আফগান সুলতান প্রথম গিয়াস উদ্দীন বাহাদুরের শাসনামলে (১৫৫৪-১৫৬০ সালে) নির্মিত। সে হিসাবে মসজিদটির বর্তমান বয়স ৪৬২ বছর।

কুসুম্বা মসজিদে ব্যবহৃত পাথর অন্য কোনো প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগৃহীত হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। এই শিলালিপি পাঠে জানা যায়, সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে তার মন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা রামন দল কর্তৃক ৯০৪ হিজরি বা ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ কবে হয় তার সঠিক কোনো সাল বা তারিখ জানা যায়নি।

ছয় গম্বুজের মসজিদ

ছয় গম্বুজের মসজিদ

এই মসজিদ দেখতে আসা অনেক পর্যটকরা পাঁচ টাকার নোটের উপর ছবি দেখেই ঘুরতে আসেন। কুসম্বা মসজিদটি নওগাঁর ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেখানে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন মসজিদটি দেখার জন্য। দর্শনার্থীদের সুযোগ-সুবিধার জন্য অযু ও গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়াও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে।

দর্শনার্থীদের আরো সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য এরইমধ্যে পিকনিক স্পট ও বিশ্রামাগারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মসজিদের একপাশে দর্শনার্থীদের রান্না-বান্নার জন্যও ব্যবস্থা রয়েছে। এর প্রবেশদ্বারের বাইরে রয়েছে বেশ কিছু দোকানপাট। এসব দোকান থেকে সৌখিন জিনিস কিংবা খাবার কিনতে পারেন দর্শনার্থীরা।

যেখানে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে আফসোস করতে হয়। সেদিক দিয়ে অবশ্য কুসুম্বা মসজিদ ব্যতিক্রম বলা যায়। সুন্দর ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই সংরক্ষণ করা হচ্ছে প্রাচীন এই নিদর্শনটি

পাঠকের মতামত

Comments are closed.