268489

হাকালুকির বুকে ‘অদ্ভুত’ সূর্যাস্ত, মুগ্ধ পর্যটক

অথই জলের ভাসানে টলমল করে নাচছে হাকালুকি হাওরের বুক। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে একে অপরের গায়ে। কেউ বলেন আফাল। এখানে ওখানে ভাসমান, দ্রুত ও ধীরে ছুটে যাওয়া ছোট-বড় অনেক নাও। দূরে দূরে সবুজ রেখার মতো গ্রামগুলো যেন ভেসে আছে জলের বুকে। হিজল-করচের বাগান জলের ওপর বুক ভাসিয়ে দাঁড়ানো।

ওপারে যখন সূর্যটা একটু একটু করে ডুবছে, হাওরের ঝিলিক দেয়া রুপালি বুক আর আগের মতো নেই। বদলাতে শুরু করে। হাওরের জলে তখন লাল-হলুদের মাখামাখি। শেষ বিকেলের রং মেখেছে মেঘদলও। রঙিন মেঘ নেমে আসে হাওরের জলে। টুকরো টুকরো হয়ে ভাসে, ডুবে।

হাকালুকি হয়তো প্রতিবারই বর্ষায় এমন রূপের মায়া মেলে ধরে। এবার করোনাকাল বলেই কি না, হাকালুকির হাওরের সেই মুগ্ধতা, সেই মায়া যেন চেনা গণ্ডি ছাড়িয়ে আরো হাজারো চোখকে ছুঁয়ে গেছে। পর্যটকের চোখে হাকালুকি হাওরের সৌন্দর্য উপভোগের মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে।

করোনার দমবন্ধ পরিবেশ মানুষের জীবনকে এক রকম দুর্বিষহ করে তুলছে। টানা পাঁচটি মাস ঘরবন্দি জীবন, কেমন যেন অশান্তি অস্বস্তিকর। সব কিছু ধরা ছোঁয়ার বাইরে। করোনা সংক্রমণের ভয়ে গেলো ঈদুল ফিতর প্রত্যেকেই ঘর বন্দী সময় কাটিয়েছেন। কেউ কোথাও বেরুনোর সাহস পায়নি।

তবে এবারের ঈদুল আজহায় সব ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে মৌলভীবাজারে এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকির নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে ভিড় জমিয়েছেন পর্যটক। বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটকদের উপস্থিতিতে মুখরিত হাকালুকি হাওর পাড়।

বিশাল আকৃতির জলমগ্ন, জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর এই হাওর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলায় তার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত রয়েছে। এসব উপজেলার সবকটি স্থানই হাওরের নৈসর্গিক বিশালতার সৌন্দর্যে মুগ্ধতা এনে দিয়েছে। তবে বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউপির এ পর্যটন স্পট, সব সময়ই অন্যরকম আবেদন ছড়িয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা ও শীত মৌসুমে শতশত পর্যটকের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে উঠে।

বিস্তীর্ণ হাওরজলের মায়াবী আলিঙ্গন, নীরব জলের বুকে সূর্যের ডুব সাঁতার, সন্ধ্যায় হইহুল্লোড় ভুলে-পাখিদের ঘরে ফেরা, অভয়াশ্রম খ্যাত হাল্লা গ্রামের মনোহর আলী মাস্টারের পাখি বাড়ি- এসব দেখে নিতেই মূলত পর্যটকদের এখানে আসা। তবে দেখা গেলো, বন বিভাগের পর্যবেক্ষণ চৌকি, বিট কর্মকর্তার কার্যালয়ের ছাদ ছাড়াও পর্যটন ভবনেও ছিলো উপচেপড়া ভিড়। অনেকে পর্যবেক্ষণ চৌকি থেকে লাফিয়ে পড়ছেন জলে। কেউবা আবার জল ছুঁয়ে কাটছেন সাঁতার। যেসব পর্যটক এসব লাফালাফি দাপাদাপি পছন্দ নয়- তারা আবার চুপিসারে নৌকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন জলের বুকে।

সন্ধ্যার আবছায়ায় দূরপারে যখন সূর্য নামে। বর্ষাভরা হাওর বুক তখন অন্যরকম মায়াবী সাজে একটু একটু করে বদলাতে থাকে। তখন সূর্যের লাল আভায় দূরের গাছ-গাছালি, দূর গ্রাম অস্পষ্ট রেখায় চিহ্নিত হয়ে পড়ে।

হাওর পাড়ের বন কর্মকর্তা তপন চন্দ্র জানান, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দেশের সবগুলো পর্যটন স্পষ্ট এখনো বন্ধ। কোথাও মানুষের কোলাহল নেই। তবে মৌলভীবাজার বড়লেখা তালিমপুর হাকালুকি হাওর পাড় ঈদের পরদিন থেকেই হাজারো পর্যটকদের উপস্থিতিতে সরগরম।

তিনি জানান, গত সপ্তাহ কম করে হলেও বিশ হাজার পর্যটকের উপস্থিতি দেখা গেছে। অথচ ঈদের আগে এতো পর্যটক দেখা যায়নি। পর্যটক আসায় কর্মহীন হয়ে থাকা অনেক মাঝিদের আয় রোজগারেরও একটি পথ খুলেছে। কথা হয় একাধিক মাঝিদের সঙ্গে।

তারা জানান, করোনায় তাদের আয় রোজগারেও ভাটা পড়েছিলো। এ ঈদে লোকজনদের উপস্থিতিতে এখন তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে পর্যটকের চেয়ে নৌকা কম থাকায় পর্যটকরা একটু বেকায়দায় পড়ছেন। আর এ সুযোগে মাঝিদের অতিরিক্ত ভাড়া হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

আর করোনা সংক্রমণে পর্যটক দু’একজন স্বাস্থ্যবিধি সচেতন থাকলেও, অনেকেই তা মানতে দেখা যায়নি। বন বিট কর্মকর্তা পর্যটকদের এতো চাপ সামালাতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানালেন। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসছেন পর্যটক।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহি আবিদ জানান, অনেক দিন পর বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ঘুরতে আসা। হাওরের রূপ দেখে তিনিসহ তার বন্ধুরা মুগ্ধ।

চাকরিজীবী লুৎফুর রহমান, শিক্ষক নাজিম উদ্দিনসহ আগত অনেকেই জানান, বর্ষায় হাওরের সৌন্দর্যে তাদের মন ভরে গেছে।

অন্য আরেকজন জানান, কক্সবাজারের চেয়েও কম নয়- হাকালুকি হাওর। স্থানীয় সংবাদকর্মী এ জে লাভলু জানালেন, পর্যটন হিসেবে এটি একটি চমৎকার স্পট। শুধু সরকারের সার্বিক সহযোগিতার প্রয়োজন।

হাকালুকির বুকে যখন সন্ধ্যা নামে। তখন হাল্লা পাখি-বাড়ির পাখিরা একান্ত নিজ প্রচেষ্টায় ডানা ঝাঁপটিয়ে ঘরে ফিরতে শুরু করে। আর হালকা অন্ধকার ভেদ করে মাঝিবাড়িদের ডিঙ্গি নৌকাগুলো, সারাদিনের ক্লান্তি মুছে একে এক পাড়ে ভিড়তে থাকে। আগামীর কর্মের প্রত্যাশা নিয়ে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.