268335

রহস্যময় জাহাজ থেকে উধাও ৫০ যাত্রীর খোঁজ মেলেনি ১৫০ বছরেও

টাইটানিকের আটলান্টিকে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা তো এখন পুরনো। তবে এমন অনেক জাহাজ সমুদ্রে যাত্রাপথে প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা জলদস্যুর হাতে পড়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। কখনো তাদের গন্তব্যে আর পৌঁছাতে পারে না। অনেক সময় আকস্মিকভাবে তাদের সমুদ্রের নিচে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে আজ যে জাহাজটির কথা বলছি সেটি কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা জলদস্যুর হাতে পড়েনি। রহস্যজনকভাবেই এর সব যাত্রী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল।

দিনটি ছিল ১৮৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর। তখন ব্রিটিশ ব্রিগেন্টিন জাহাজ ‘দেই গ্রাটিয়া’ অ্যাজোর্স থেকে প্রায় ৪০০ মাইল পূর্বে অবস্থান করছিল। হঠাৎ করেই জাহাজের নাবিকদের চোখে ধরা পড়ল এক অদ্ভুত ব্যাপার। তাদের জাহাজ থেকে সামান্য কিছুটা দূরে অন্য একটি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। তবে তারা অপর জাহাজের ডেকে কোনো মানুষ দেখতে পাচ্ছিল না। আবার জাহাজটিকে দেখে মনে হচ্ছিল সেটি ক্ষতিগ্রস্তও না। আর আবহাওয়া এমন খারাপ নয় যে জাহাজের নাবিকদের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে।

গ্রাটিয়ার ক্যাপ্টেন ডেভিড মোরহাউস বেশ কৌতূহলী হলেন। ভালোভাবে লক্ষ্য করে বুঝতে পারেন এই জাহাজটি তার চেনা। তিনি বেশ অবাক হয়ে যান। মেরি সেল্যাস্ট নামের সেই জাহাজটি তার জাহাজ থেকে প্রায় আট দিন আগে ইতালির জেনোয়ার উদ্দেশ্যে নিউ ইয়র্ক বন্দর ছেড়েছিল। এত দিনে মেরি সেল্যাস্টের ইতালির বন্দরে পৌঁছে যাবার কথা! তবে এখানে উদ্দেশ্যহীনভাবে জাহাজটি ভাসছে কেন? বন্দর তো এখনো বেশ খানিকটার পথ। ক্যাপ্টেনের মনে সন্দেহ উঁকি দিল।

দেরি না করে তিনি ততক্ষণাৎ নিজের জাহাজের নাবিকদের নির্দেশ দিলেন ‘মেরি সেল্যাস্টের’ কাছে জাহাজ নিয়ে যেতে। জাহাজের কাছে গিয়ে আরো নিশ্চিত হন তারা। যে জাহাজে কোনো মানুষ নেই। এবার ক্যাপ্টেন ডেভিড মোরহাউস উদ্ধারকারী নৌকা পাঠালেন সেখানে। কোনো ধরনের বিপদে যে পড়েছে জাহাজটি সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেখানে নেই কোনো মানুষ। উদ্দেশ্যহীনভাবে সমুদ্রে ভাসছে শুধু জাহাজটি। এই বিষয়টি জানার পর দেই গ্রাটিয়া জাহাজের সবাই হতবাক হয়ে গেল। মেরি সেল্যাস্ট কোনো ধরনের চালক ছাড়াই ভেসে বেড়াচ্ছে! কোনো ধরনের আক্রমণ, মহামারি, দুর্ঘটনা কিছুর চিহ্নই নেই জাহাজে। শুধু মানুষগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

উদ্দেশ্যহীনভাবে এভাবেই সমুদ্রে ভাসছিল মেরি সেল্যাস্ট

উদ্দেশ্যহীনভাবে এভাবেই সমুদ্রে ভাসছিল মেরি সেল্যাস্ট

মেরি সেল্যাস্ট জাহাজের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে প্রায় সব ক্যাপ্টেনদেরই জানা ছিল। যাত্রীদের রহস্যময় অন্তর্ধানের বিষয়কে আরো স্পষ্ট করে তোলে অতীতের ইতিহাস। নির্মাণের পর থেকে সবসময়ই কোনো না কোনো সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে জাহাজটিকে। ১৮৬১ সালে স্পেন্সার্স আইল্যান্ড, কানাডায় নির্মাণ করা হয় জাহজটি। তখন এর নাম ছিল অ্যামাজন। এই অ্যামাজন অর্থ দুই নারী।

১৮ মে, ১৮৬১ সালে সমুদ্র যাত্রার শুরুর পর থেকেই শুরু হয় নানা সমস্যা।প্রথম যাত্রাতেই ক্যাপ্টেন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন এবং পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন। বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনার মুখেও পড়ে অ্যামাজন। যার মাঝে ১৮৬৭ সালে কাউ বে-র কাছে অপর একটি জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষের দুর্ঘটনাটি ছিল বেশ বড় ধরনের। সেই একই বছর জাহাজের মূল মালিক অ্যামাজনকে বিক্রি করে দেন আমেরিকান ব্যবসায়ী রিচার্ড হেন্সের কাছে, যিনি পরবর্তীতে অ্যামাজনের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘মেরি সেল্যাস্ট’।

নতুন মালিক জাহাজটিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। তিনি জাহাজটি বিক্রি করে দেন ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন স্পুনার ব্রিগসের কাছে।জাহাজটি যাত্রাকালে ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন স্পুনার ব্রিগসের সঙ্গে তার স্ত্রী সারাহ, দুই বছরের কন্যা, সাতজন ক্রু এবং ৫০ জনের মতো যাত্রী ও শ্রমিক ছিল। পুরো জাহাজ ভালোভাবে খুঁজে সমাধানের বদলে আরো বিভ্রান্তিতে পড়ল দেই গ্রাটিয়ার উদ্ধারকারী নাবিক দল।

জাহাজের খাবারের গুদামে পাওয়া গেল প্রায় ছয় মাসের রসদ আর পানীয়। নাবিক আর রাঁধুনিদের থাকার কেবিনগুলোতে মানুষ বসবাসের চিহ্ন রয়েছে। এমনকি ক্যাপ্টেনের কেবিনের দৃশ্যও একই রকম। কোনো ধস্তাধস্তি কিংবা আক্রমণের চিহ্ন নেই কোথাও। স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু সাজানো আছে। কেউ যে এখানে থেকেছে তারও প্রমাণ মেলে। কেবিনেটে সাজানো অবস্থায় আছে জামা-কাপড়, নিত্য ব্যবহার্য সব কিছুই। ক্যাপ্টেনের ঘরে তার এবং স্ত্রীর পোশাক, বাচ্চার খেলনা ছিল। আর বিছানার নিচে পাওয়া গেল খাপে ভরা একটি তলোয়ার।

ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন স্পুনার ব্রিগস

ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন স্পুনার ব্রিগস

কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়া জাহাজ ছেড়ে সবাই কোথায় চলে গেল এর কোনো চিহ্ন নেই কোথাও। জাহাজটিতে একটি মাত্র লাইফবোট থাকার কথা। তবে সেটি কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। জাহাজের খোলে জমে যাওয়া পানি সেঁচে ফেলার জন্যে মেরি সেল্যাস্টে ছিল দুটি পাম্প। সেগুলো খোলা অবস্থায় ডেকের উপরে পরে ছিল।

গত দশ দিনে নিয়ন্ত্রক ছাড়া ভেসে বেড়ানোর জন্য হোক অথবা অন্য কোনো কারণে, মেরি সেল্যাস্টের খোলের ভেতরে প্রায় সাড়ে তিন ফুট পানি জমে গিয়েছিল। তবে জাহাজের কোথাও এমন কোনো ক্ষতির চিহ্ন পাওয়া যায়নি যে কারণে জাহাজটি ডুবে যাবার আশঙ্কা করা যেতে পারে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো-

জাহাজটিতে থাকা ১৭০১ ব্যারেল বাণিজ্যিক অ্যালকোহলের প্রায় সবটাই পাওয়া গেল অক্ষতাবস্থায়। এই ১৭০১ ব্যারেল অ্যালকোহলের মাঝে লাল ওক কাঠের তৈরি নয়টি ব্যারেল শুধু খালি অবস্থায় পাওয়া যায়। বাকি সাদা ওক কাঠের তৈরি ব্যারেলগুলো পাওয়া যায় অ্যালকোহলে পূর্ণ অবস্থায়। তবে এই নয়টি ব্যারেল কীভাবে খালি হলো আর বাকিগুলো কীভাবে অক্ষত রয়ে গেল সেই বিষয়ে সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি।

মেরি সেল্যাস্টের যাত্রীদের রহস্যময়ভাবে উধাও হওয়ার পাশাপাশি ছিল আরো অবাক করার মতো ব্যাপার। ডেকের সামনের আর পেছনের হ্যাচ দুটো পাওয়া গেল খোলা অবস্থায়। জাহাজ চালানোর কাজে ব্যবহারের ক্রোনোমিটার, সেক্সট্যান্ট, ন্যাভিগেশন বই আর জাহাজের রেজিস্টার বইয়ের মতো দরকারি কাগজগুলো যাত্রীদের মতোই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল।তবে জাহাজের লগবুক ঠিকই খুঁজে পাওয়া গেল নাবিকদের কেবিন ডেস্কে। সেখানে শেষবারের মতো লেখা হয়েছে নভেম্বর ২৫ সকাল ৮ টায় অর্থাৎ শূন্য জাহাজ উদ্ধারের দশ দিন আগে। সেসময় জাহাজটি অবস্থান করছিল সান্তামারিয়া থেকে ৬ মাইল উত্তর-পূর্ব কোণে।

খুঁজে পাওয়ার ১০দিন পর মানবশূন্য ভুতুড়ে জাহাজটি জিব্রাল্টায় নিয়ে আসা হয়। ‘দেই গ্রাটিয়া’ জাহাজের  ক্যাপ্টেন এবং কর্মীরা ‘মেরি সেল্যাস্টকে’ ৮০০ মাইল দূরে নিয়ে আসে। যেখানে ছিল ব্রিটিশ নৌবিভাগের আদালত। সেখানে নেয়ার অন্যতম কারণ ছিল জাহাজ উদ্ধারের পুরস্কার দাবী করা। ক্যাপ্টেন এবং নাবিকরা উধাও হয়ে গেলেও তো জাহাজ এবং এর রসদ ভালো অবস্থাতেই আছে! এজন্য বীমা কোম্পানির কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ তাদের পাওয়ার কথা। প্রায় তিন মাস ধরে চলে তদন্ত।

অবশেষে জাহাজে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক কার্যকলাপ হয়নি বলে সিদ্ধান্তে আসে আদালত। তবে ‘দেই গ্রাটিয়া’ জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং অন্য কর্মীরা বীমার অর্থের মাত্র এক-ষষ্ঠাংশ হাতে পায়। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয় ভয়ানক তথ্য। আদালত জানায়, গ্রাটিয়া জাহাজের কুশলীরা ‘মেরি সেল্যাস্টের’ যাত্রীদের নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল কি না সেই বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন।

ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন স্পুনার ব্রিগসের সঙ্গে তার স্ত্রী, কন্যা

ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন স্পুনার ব্রিগসের সঙ্গে তার স্ত্রী, কন্যা

অদ্ভুত এই অন্তর্ধানের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে তৈরি হতে থাকে নানা ধরনের গল্প। লোকমুখে মূল কাহিনী বদলে ‘মেরি সেল্যাস্ট’ হয়ে ওঠে অতিপ্রাকৃত এক জলযান। ১৮৮৪ সালে সময়ের অন্যতম লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল ‘কর্ন হিল’ ম্যাগাজিনের জন্য একটি গল্প লেখেন ‘মেরি সেল্যাস্টের’ যাত্রীদের রহস্যময় অন্তর্ধানের উপর ভিত্তি করে। গল্পটির নাম ছিল ‘যে হাবাকুকের জবানবন্দি’।

এতে আবারো পুরোনো সেই কাহিনী নতুন করে সবার আগ্রহের বস্তুতে পরিণত হয়। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল পর্যন্ত কেস ফাইল পুনরায় খোলার নির্দেশ দেন এবং কেসের পুরোনো ফাইলগুলো আবারো ঘেঁটে দেখেন। কিন্তু নিখোঁজ যাত্রীদের অন্তর্ধান রহস্যের কোনো সমাধান তিনি করে যেতে পারেননি।

এই জাহাজ নিয়ে তৈরি হয় নানা কাহিনী। এর যাত্রীদের নিখোঁজ হওয়ার কারণ হিসেবে উঠে আসে অনেকগুলো দিক। তবে কোনোটাই তেমন জোড়াল হয়নি শেষ পর্যন্ত।এর কিছু একেবারেই রুপকথার মতো, আবার কিছু রীতিমতো সঠিক হবার মতো। যেমন- জলদস্যুর আক্রমণ কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পথ হারিয়ে ফেলার মতো বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্বও শোনা যেতে থাকে এর রহস্য হিসেবে। তবে জলদস্যুর আক্রমণ কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কোনো আলামতই ছিল না জাহাজটিতে। জাহাজে প্রচুর মালামাল একেবারে অক্ষত অবস্থায়ই ছিল।

মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে মেরি সেল্যাস্ট

মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে মেরি সেল্যাস্ট

আবার অনেকে বলতে থাকেন এমনো হতে পারে জাহাজে বিদ্রোহ হবার কারণে নাবিকরা দুই দলে ভাগ হয়ে যায় এবং তাদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। তবে নাবিকদের পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, তেমন আচরণ করার মতো কেউ জাহাজে ছিল না। তাই এ ধারণাও শেষ পর্যন্ত বাদ দিতে হয়।

তবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন, জাহাজের খোলে পানি জমার পরিমাণ নির্ণয়ের জন্যে ক্যাপ্টেন যে সাউন্ডিং রড ব্যবহার করেছিলেন তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। যে কারণে ক্যাপ্টেন মনে করেন আসলের চেয়ে অনেক বেশি পানি জমে গেছে জাহাজের ভেতরে। সেই সঙ্গে পানি নিষ্কাশনের দুটো পাম্পের একটি অকেজো হয়ে পড়ায় ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে পড়ে। জাহাজের লগবুকের শেষ তথ্য অনুসারে জানা যায়, তারা গন্তব্য ঠিক করতে বেশ কয়েকবার দিক পরিবর্তন করে।

তবে যাই হোক এই জাহাজটি সব অতীত মুছে আবারো যাত্রা করেছিল সমুদ্রপথে। ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার মালিক বদল হলেও বহাল তবিয়েতেই সমুদ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে জাহাজটির। তবে দুর্ভাগ্য নিয়ে যে জাহাজের যাত্রা শুরু, তার শেষও দুর্ভাগ্য দিয়েই হয়। ১৮৮৫ সালে ‘মেরি সেল্যাস্টের’ তৎকালীন মালিক ক্যাপ্টেন জি সি পার্কার বীমার টাকার লোভে হাইতির কাছাকাছি অঞ্চলে ইচ্ছাকৃতভাবে জাহাজের সঙ্গে প্রবাল প্রাচীরের সংঘর্ষ ঘটান।

তবে এখানেও ভাগ্য সহায় হয়নি মালিকের। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও ডুবে যায়নি মেরি সেল্যাস্ট। বীমা কোম্পানি বিষয়টি ধরে ফেলে এবং কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সংস্কারের অযোগ্য হয়ে যাওয়ায় এখানেই শেষ হয়ে যায় মেরি সেল্যাস্টের জীবনকাহিনী

পাঠকের মতামত

Comments are closed.