268310

পুরুষ বেশে সিংহাসনে, মিশরের নারী ফারাওদের বৈচিত্র্যময় জীবন

মিশরের শাসক বা রাজাদেরকে বলা হয় ফারাও। মিশরের রাজা বা ফারাওদের কথা বললে তৎক্ষণাৎ আমাদের চোখে নীল আর সোনালি মুকুট পরে সিংহাসনে বসে থাকা একজন পুরুষের অবয়বই ভেসে ওঠে। যদিও মিশরের শাসকদের বেশিরভাগই পুরুষ ছিলেন।

তারপরও ফারাও শব্দটা বিরলভাবে নারী শাসকদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হত। মিশরের ইতিহাসে নারী ফারাওরা বেশখানিকটা জায়গা জুড়েই রয়েছে। মিশরের সমৃদ্ধিতে তাদের অবদানও অনেক। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মিশরের তিন হাজার বছরের ইতিহাসে ১৭০ জন ফারাওয়ের মাঝে সাত জন ছিলেন নারী।

যদিও এই সংখ্যা নিয়ে ইতিহাসবিদদের সন্দেহ রয়েছে। কারণ অনেক নারী শাসকের নামই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। আগের পর্বগুলোতে মিশরের জীবনযাপন, সভ্যতা, পিরামিড, মমি ছাড়াও বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জেনেছেন। আজকে নবম পর্ব সাজানো হয়েছে মিশরের নারী ফারাওদের বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে। তাদের অবদান মিশরের সমৃদ্ধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের জীবনও ছিল বেশ বৈচিত্র্যময়। তবে চলুন জেনে নেয়া যাক মিশরের নারী ফারাওদের সম্পর্কে-

নারী ফারাও

নারী ফারাও

সোবেকনেফেরু

মিশরের প্রথম নারী ফারাও ছিলেন সোবেকনেফেরু। তিনি তৃতীয় ফেরাউন আমেনেমহাটের কন্যা। তাকে নেফারুসোবেক ও বলা হয়। এর অর্থ সোবেক এর সৌন্দর্য্য। তিনি ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর মিশরের অন্যতম ও প্রথম নারী ফারাও। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০৬ থেকে ১৮০২ পর্যন্ত চার বছর তিনি মিশর শাসন করেছেন। তার অনেক ভাস্কর্য পাওয়া যায় পুরো মিশরজুড়ে। এর মধ্যে অনেকগুলোই অবশ্য মাথা ছাড়া!

এর যুক্তিযুক্ত কারণ জানা সম্ভব হয়নি। কেন তার মূর্তির মাথা ভাঙ্গা ছিল তাও বেশ রহস্যের ব্যাপার। গেযের এ আবিষ্কৃত ভাস্কর্যগুলো রাজার রাজকীয় কন্যা নামে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তিনি হাওয়ারার আমেনেনহাট তৃতীয় এর পিরামিড কমপ্লেক্সটির কিছু পরিবর্তন করেন বলে জানা যায়।

এছাড়াও তিনি হেরাকলিওপলিস মেগ্নার স্থাপত্যগুলো নির্মাণ করেন। তার মৃত্যু কীভাবে হয় বা কবর কোথায় এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, মাঝঘুনা পিরামিডটি তার সৌধ। সোবেকনেফেরু ছিলেন নিঃসন্তান। তার সময় মিশর স্বর্ণ যুগে পা রেখেছিল।

সোবেকনেফেরু

সোবেকনেফেরু

হাতশেপসুত

হাতশেপসুত ছিলেন মিশরীয় নারী ফারাওদের মধ্যে দ্বিতীয় এবং অন্যতম। প্রাচীন মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের পঞ্চম ফেরাউন ছিলেন তিনি। হাতশেপসুত অর্থ হলো ‘মহৎ নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ’! প্রাচীন মিশরবিদরা তাকে সাধারণভাবে সর্বাপেক্ষা সফল ফেরাউনদের একজন হিসেবে গণ্য করেন। মিশরীয় রাজবংশের অন্যান্য নারীদের থেকে তার রাজত্বকাল ছিল দীর্ঘতর।

হাতশেপসুতের জন্ম হয়েছিল ১৪৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এর আশেপাশে কোনো এক সময় সিংহের গুহায়। তিনি প্রথম থুতমোসের কন্যা এবং দ্বিতীয় থুতমোসের প্রধান স্ত্রী ছিলেন। শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন চমৎকার। নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামে তার জন্য আলাদা একটি কক্ষই আছে। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে তার জীবনকালের নিদর্শনসমূহ।

পুরুষ বেশে সিংহাসনে বসতেন হাতশেপপুত

পুরুষ বেশে সিংহাসনে বসতেন হাতশেপপুত

যিশু খ্রীষ্টের জন্মের ১৫০০ বছর আগের প্রাচীন সময়ে তিনি মিশর শাসন করেন। হাতশেপসুত আনুমানিক ১৪৭৯ থেকে ১৪৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পর্যন্ত সহ-শাসক হিসাবে মিশরে রাজত্ব করেন। সব মিলিয়ে তার শাসনকাল ছিল ২১ বছর নয় মাস। তার সময় অসাধারণ সব স্থাপত্য নির্মিত হয়েছে। তিনি পুরুষের পোশাক পরে সিংহাসনে বসতেন, এমনকি ফারাও এর নকল দাড়িও লাগাতেন। মিশরীয় গবেষক জেমস হেনরির মতে, হাতশেপসুত ইতিহাসে উঠে আসা প্রথম মহৎ নারী।

নেফারতিতি আখামেননের 

সম্মানিত রানি ছিলেন নেফারতিতি। তবে তার স্বামী পরবর্তীতে তার নাম দেন নেফের-নেফেরু-আটন দেন। যার অর্থ সুন্দর এসেছে। নেফারতিতির ছিল অনেক উপাধি যেমন- হেরেডিটারি প্রিন্সেস, গ্রেট অব প্রাইসিস, লেডি অব গ্রেস, সুইট অব লাভ, লেডি অব দ্য টু ল্যান্ডস, মিস্টরিস অব আপার এন্ড লোয়ার ইজিপ্ট। নেফারতিতি এবং তার স্বামী ধর্মীয় আমূল পরিবর্তনের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। তারা এক দেবতায় বিশ্বাসী ছিলেন। সূর্য দেবতা এটন।

নেফারতিতি ও তার স্বামীর মূর্তি

নেফারতিতি ও তার স্বামীর মূর্তি

স্বামীর মৃত্যুর পর নেফারতিতি সাম্রাজ্যের ভার নেন। তার ছিল ছয় কন্যা সন্তান। আখামেননের উত্তরাধিকারী তুতখামেন জন্ম হয় তারই বোনের গর্ভে। নেফাররিউতেন নামে ক্ষমতায় বসেছিলেন তিনি। তিনি কীভাবে মারা যান তা জানা যায়নি। তবে যতটুকু ইতিহাস তার পাওয়া যায়, তা ছিল গৌরবময়, উজ্জ্বল।

আনাক-সু-নামুন

বেশ রহস্যময় ছিল এই ফারাওয়ের জীবন। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪৮ সালে আনাক-সু-নামুনের জন্ম। বাবা ফারাও আখেনাতেন ও মা নেফারতিতির ঘরে জন্ম তার। আনাক-সু-নামুন একাধারে তুতেনখামেনের মাতামহী, মা, বোন ও স্ত্রী ছিলেন। মিশরের রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের অংশ বলতেন। সিংহাসনে দেবতার অধিকার কায়েম রাখতে, খুব কাছের আত্মীয়কে বিয়ে করতেন তারা।

আনাক-সু-নামুন দেখতে এমনই ছিলেন

আনাক-সু-নামুন দেখতে এমনই ছিলেন

নিজেদেরকে দেবতা বলে মনে করায় তারা বংশের বাইরে কাউকে বিবাহ করত না। ফলে ভাই-বোনেদের মধ্যেই বিবাহ সম্পন্ন হত। পিতা আখেনাতেনের মৃত্যুর পর তুতেনখামেন সেসময় মিশরের রাজা হলেও তার বয়স ছিল কম। ফলে বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য তাকে বিভিন্ন মন্ত্রী ও উপদেষ্টার সাহায্য নিতে হত।

আনাক-সু-নামুনও তার স্বামীকে রাজ্য পরিচালনায় বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন। তাদের বাবা মিশরের সমাজ ব্যবস্থার যে ক্ষতি করেছিলেন তা ঠিক করার চেষ্টা করেন আনাক-সু-নামুনও তার স্বামী। তিনি মিশরীয় নারী ফারাওদের মধ্যে অন্যতম একজন। রহস্যজনকভাবে মিশরের ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে।

নিতক্রিস আত্মহত্যা করেন

নিতক্রিস আত্মহত্যা করেন

এমনকি তার সমাধি কোথায় তারও সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। নানা বৈচিত্র্যময় জীবনের এই ফারাও এখন কোথায় শুয়ে আছেন কেউ জানে না। তবে ধারণা করা হয়, ভ্যালি অব দ্য কিংস নামক স্থানটিতে এর আগে তুতেনখামেনসহ মিশরের নানা গুরুত্বপূর্ণ ফেরাউনের সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়। হয়তো এরই কোনো একটিতে চিরনিদ্রায় শুয়ে রয়েছেন মিশরের ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময়ী রানি আনাক-সু-নামুন।

নিতক্রিস

নিতক্রিসকে রানি নেতেরকের অথবা নিতিকর্তিও বলা হয়। তিনি রাজা দ্বিতীয় পেপি এবং রানি নেইথ এর কন্যা ছিলেন। মনে করা হয়, দ্বিতীয় মেরেন্র নেমটাইমসাফ এর বোন ছিলেন তিনি। নিতক্রিস ষষ্ঠ শতকে মিশর শাসন করেন। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের মতে, তিনি তার ভাইয়ের হত্যাকারীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পরে তাকে হত্যা করেন। অন্য ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে বাঁচতে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।

খেনকস প্রথম

খেনকস প্রথম

খেনকস প্রথম  

চতুর্থ শতাব্দীর ফারাও ছিলেন প্রথম খেনকস। ধারণা করা হয়, তিনি ফারাও মেনকয়ারের কন্যা। তার সমাধি আছে গিজার পিরামিডে। তার কবরকে বলা হয় এলজি ১০০ এবং জি ৮৪০০। তিনি ছিলেন মিশরের একজন উল্লেখযোগ্য নারী শাসক। শাসনকার্যের প্রয়োজনে তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করতেও পিছপা হননি। ধৈর্যশীল এবং দূরদর্শী এই নারীর সমাধি কমপ্লেক্সটিতে আছে মন্দির এবং নৌকা পিট।

ক্লিওপেট্রা

মিশরীয় নারী ফারাও ক্লিওপেট্রার নাম শোনেননি এমন কাউকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তার সৌন্দর্যের উপমা দেন এখনো অনেকে। সপ্তম ক্লিওপেট্রা ফিলোপাটর, তবে তিনি বহুল পরিচিত ক্লিওপেট্রা নামে। তিনি ছিলেন মিশরের শেষ নারী ফারাও। ক্লিওপেট্রা একটি গ্রিক শব্দ, এর অর্থ ‘বাবার গৌরব’। প্রকৃতপক্ষে ক্লিওপেট্রা প্রথমে তার বাবা দ্বাদশ টলেমী এবং পরে ভাই ত্রয়োদশ টলেমী ও চতুর্দশ টলেমীর সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করেন।

ক্লিওপেট্র

ক্লিওপেট্র

পরবর্তীতে ভাইদের সরিয়ে একাই সাম্রাজ্যের ভার নেন। ভাইদের প্রতি জুলিয়াস সিজারের রাগকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে তিনি গভীর রাতে সিজারের প্রসাদে চলে যান। ‘লাইফ অব জুলিয়াস সিজার’ এ জানা যায়, কীভাবে ক্লিওপেট্রা নিজেকে কার্পেটে মুড়িয়ে সব সেনার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করতেন। সিজারের দত্তক পুত্র এবং সফল শাসক অক্টেভিয়ানের সঙ্গে তার রাজনৈতিক এবং প্রেমের উভয় সম্পর্কই ছিল।

তিনি ছিলেন চৌকশ, বুদ্ধিমতী এবং দূরদর্শী নারী শাসক। তার মৃত্যু নিয়ে এখনো রয়েছে ধোঁয়াশা। অনেক জায়গায় বলা হয় শত্রুর পাঠানো ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে থাকা সাপের কামড়ে দুই দাসীসহ মারা যান তিনি। আবার অনেক জায়গায় প্রমাণ পাওয়া যায় ক্লিওপেট্রার স্বামী যখন অক্টেভিয়ানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। তখন তিনি স্বামীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। চিঠিতে লিখেছিলেন, অক্টেভিয়ানের সঙ্গেই একই জায়গায় যেন তাকে সমাহিত করা হয়।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.