268262

সীমান্তে চীন-ভারত কার সামরিক শক্তি বেশি

কয়েক সপ্তাহ ধরে সীমান্তে চীন-ভারত উত্তেজনা চলছে। পারমাণবিক ক্ষমতা সম্পন্ন দুই দেশের সঙ্গে অমীমাংসিত ২২ মাইল প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা রয়েছে। ১৯৬২ সাল থেকে অরুনাচল, সিকিম ও লাদাখ সীমান্তে প্রতিবেশী দুই দেশের সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে।

এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে দুই দেশ সীমান্তে সেনা মোতায়েন জোরদার করছে। নতুন করে উত্তেজনার মধ্যে কথা উঠেছে প্রতিবেশী দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে। চলতি বছরের মার্চ মাসে হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের বেলফার সেন্টারের সামরিক বিশেষজ্ঞরা ভারত ও চীনের মধ্যে একটি তুলনামূলক সামরিক শক্তির বিশ্লেষণ করেছিলেন। বেলফারের দুই বিশেষজ্ঞ ফ্রাঙ্ক ও’ডোনেল এবং অ্যালেক্স বলফ্রাস এ বিশ্লেষণ করেন।

এ ছাড়া একই রকমভাবে, ২০১৯ সালের অক্টোবরে সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি (সিএনএএস) নামে একটি গবেষণা সংস্থাও একই রকম তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছিল। বেলফার সেন্টার ও সিএনএএস প্রকাশিত এই দুই বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, সামরিক প্রস্তুতিতে চীন ও ভারতে কার অবস্থান কোথায়।

স্থলবাহিনী

বেলফারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর চীনের মোকাবেলা করতে ভারত অন্তত ২ লাখ ২৫ হাজার সেনা মোতায়েন করতে সক্ষম। তার মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডে সেনা সংখ্যা প্রায় ৩৪ হাজার। এর মধ্যে লাদাখে রয়েছে টি-৭২ ব্রিগেডের ১৫০টির মতো ট্যাঙ্ক এবং ৩০০০ বাহিনী। এ ছাড়াও রয়েছে অষ্টম মাউন্টেন ডিভিশন এবং তৃতীয় ইনফ্যান্ট্রির সেনারা।

মধ্যাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনে রয়েছে ষষ্ঠ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রায় ১৬ হাজার সেনা।
পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনে চীনা সীমান্তে রয়েছে ভারতীয় সেনার ৯টি মাউন্টেন ডিভিশনের প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার সেনা। তার সঙ্গে রয়েছে অরুণাচলের ব্রহ্মস মিসাইল রেজিমেন্ট।

ভারত-চীন বিমান বহর

প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ধরে চীনা বিমান বাহিনী ভারতের বিমান বহরের থেকে সংখ্যা এবং গুণগত দু’দিক থেকেই পিছিয়ে বলে দাবি গবেষকদের।

চীন-ভারত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা অংশটি চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের আওতাধীন। সেখানকার রীতি অনুযায়ী, ওই পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের অন্তর্ভুক্ত বিমান বাহিনীও। ওই কমান্ডের অধীনে ১৫৭টি যুদ্ধবিমান, বোমা ফেলতে বা আক্রমণ করতে সক্ষম ড্রোন রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এর বড় একটা অংশই রাশিয়ার জন্য সংরক্ষিত। অর্থাৎ রুশ ফ্রন্ট থেকে কোনো আক্রমণ হলে তা রোখার জন্য বিশেষভাবে রাখা রয়েছে ওই বিমান বহরের একটি বড় অংশ।

কিন্তু ভারত বিমান বাহিনীর উত্তরাঞ্চলীয়, মধ্য এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অন্তত ২৭০টি যুদ্ধবিমান এবং ৬৮টি গ্রাউন্ড অ্যাটাক এয়ারক্রাফ্ট বিমানবাহিনী ব্যবহার করতে পারে চীনের নিয়ন্ত্রণরেখায়।

গুণগত দিক থেকেও ভারতের চতুর্থ প্রজন্মের ফাইটারের সংখ্যা চীনের তুলনায় এই অংশে বেশি। চীনের জে-১০ এবং জে-১১ ফাইটার বিমানগুলোর সমকক্ষ ভারতের মিরাজ-২০০০। কিন্তু ভারতের সুখোই-৩০ এমকেআই, চীনা চতুর্থ প্রজন্মের বিমানের থেকে আরও বেশি আধুনিক এবং কার্যকরী।

চীন-ভারত নৌবাহিনী

১৩৭টি যুদ্ধজাহাজ ও ২৯১টি বিমান রয়েছে ভারতীয় নৌবহরের অধীনে। রয়েছে পরমাণু জ্বালানিতে চলা সাবমেরিনও।

আয়তনে চীনা নৌবহর ভারতের তুলনায় অনেক বড় হলেও, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে ভারতীয় নৌবহর সঙ্কীর্ণ মলাক্কা প্রণালীতে নজরদারি বাড়িয়েছে। মলাক্কা প্রণালী কৌশলগত দিক থেকে চীনা নৌবহরের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। অন্যদিকে চীনা নৌবহরের বড় অংশই ব্যস্ত দক্ষিণ চীন সাগরে, যেখানে চীনের বন্ধু রাষ্ট্রের থেকে শত্রুর সংখ্যা বেশি।

ভারত-চীন পরমাণু ক্ষমতাধর

বেলফার সেন্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় ভূখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে চীনের অন্তত ১০৪টি পরমাণু বোমাবাহী ক্ষেপণাস্ত্র বা মিসাইল আছড়ে পড়তে পারে। চীনের হাতে দুরপাল্লা থেকে শুরু করে মাঝারি এবং স্বল্প পাল্লার ভূমি থেকে ভূমি, সাগর থেকে ভূমি, বা আকাশ থেকে ভূমি— নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।

অন্যদিকে ভারতের হাতেও রয়েছে বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। কিন্তু গবেষকদের দাবি, সেগুলোর বেশির ভাগটাই পাকিস্তানমুখী ও অবস্থানগতভাবে পাকিস্তানের কাছাকাছি। বেলফারের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ১০টি অগ্নি-৩ মিসাইল চীনের মূল ভূখণ্ডের যে কোনো অংশে আঘাত হানতে পারে। আরও ৮টি অগ্নি-২ ক্ষেপণাস্ত্র মধ্য চীন পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। অর্থাৎ ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভারের ক্ষেত্রে চীনকে এগিয়ে রেখেছেন ওই দুই গবেষক।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম দুই স্কোয়াড্রন জাগুয়ার আইএস ফাইটার এবং মিরাজ ২০০০ এইচ যুদ্ধবিমান তিব্বত পর্যন্ত সফল অপারেশন চালাতে সক্ষম হলেও, চীনের মূল ভূখণ্ডে ঢুকে অপারেশন চালাতে পারবে না। তবে সেই সঙ্গে গবেষকরা এটাও উল্লেখ করেছেন যে, ভারতীয় বাহিনী তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার আরও বিভিন্ন জায়গায় রেখেছে, যা প্রকাশ্যে আসেনি। সেখান থেকে চীনকে আকস্মিক আঘাত হানার ক্ষমতা রয়েছে ভারতের।

দু’দেশের সমর সম্ভারের এই তুলনামূলক বিচারে, বেলফার ও সিএনএএস রিপোর্ট- দুই জায়গাতেই উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের জিডিপির হিসাবে চীনের সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ ভারতের থেকে বেশি। ভারতের থেকে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় তিনগুণ।

সেনা সংখ্যায় চীন পৃথিবীর এক নম্বরে, ভারত তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে। কিন্তু চীনের সামরিক অভিমুখ বা ফোকাস মূলত আমেরিকা এবং তার বন্ধু দেশগুলোকে ঘিরে। তার বাইরে এশিয়ার এই সুপার পাওয়ার জাপান, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান বা রাশিয়ার মোকাবেলায় যতটা সামরিক শক্তি বা সমর সম্ভার তৈরি রেখেছে, ততটা তৈরি নয় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত সীমান্তে।

ভারতীয় নৌবহরে রয়েছে, ২ নিউক্লিয়ার সাবমেরিন, ১৩টি চিরাচরিত সাবমেরিন, ১ টি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ১০টি ডেস্টয়া ও ১৫টি ফ্রিগেট রয়েছে।

অপরদিকে চীনা নৌবাহিনীতে ১১ নিউক্লিয়ার সাবমেরিন, ৫৭টি চিরাচরিত সাবমেরিন, ১টি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ২৮টি ডেস্ট্রয়ার ও ৪৬টি ফ্রিগেট।

গত সপ্তাহে লাদাখের গালওয়ান উপত্যাকায় চীন-ভারতের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে এক কর্নেলসহ ভারতের ২০ সেনা নিহত হয়। এছাড়া ৭৬ সেনা সদস্য আহত হয়। অসমর্থিত সূত্রে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে চীনের ৪৩ সেনা নিহত হয়েছে দাবি করা। তবে চীনের পক্ষ থেকে হতাহতের বিস্তারিত জানানো হয়নি। ওই দিনই ভারতীয় ১০ সেনাসদস্যকে ধরে নিয়ে যায় চীন। পরবর্তীতে দুই দেশের মধ্যে চলা সামরিক বৈঠকে তাদের ফেরত দেয় বেইজিং।

এরপরই শুক্রবার সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি জানান, কেউ (চীন) সীমান্ত অতিক্রম করেনি।

পরবর্তীতে কূতনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা হলেও উভয় দেশ সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন অব্যাহত রেখেছে।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

পাঠকের মতামত

Comments are closed.