267840

দুই হাজার বছর ধরে সমৃদ্ধির স্বর্ণযুগে যেভাবে পৌঁছায় মিশর

মিশর সম্পর্কে জানার আগ্রহ সবার মনেই রয়েছে। বিশেষ করে ফারাও, মমি ও পিরামিডের কারণে মিশর সম্পর্কে বিশ্ববাসীর জানার আগ্রহ প্রবল। মিশরের প্রাক রাজবংশীয় যুগ ছিল প্রায় দুই হাজার বছর ধরে। যদিও ওই যুগের খুবই কম লিখিত রেকর্ড কিংবা বস্তুগত নিদর্শন পাওয়া গেছে।

জানা যায়, ওই যুগেই মূলত মিশরীয় সভ্যতা পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার নিওলিথিক বা নব্যপ্রস্তর যুগের বসবাসকারীরা শিকার ছেড়ে ধীরে ধীরে কৃষি কাজে দক্ষ এবং এর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এরই ধারবাহিকাতায় প্রাচীন মিশরীয়রা শিল্প, কারুশিল্প, প্রযুক্তি, রাজনীতি এবং ধর্মের বিষয়ে উৎকর্ষ সাধন করে।

মিশরীয় সভ্যতা

মিশরীয় সভ্যতা

বিশ্বাস অনুযায়ী, তারা মৃতদেরও শ্রদ্ধা নিবেদন করত। প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০০ অব্দের দিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা গড়ে ওঠার ফার্টিল ক্রিসেন্ট হিসেবে পরিচিত অঞ্চলে দুটি পৃথক জনবসতি গড়ে ওঠে। সেসময় মিশরীয় সভ্যতা উচ্চ মিশর এবং নিম্ন মিশর এই দুই অংশে বিভক্ত ছিল।

উচ্চ মিশর ছিল নগরকেন্দ্রিক বাণিজ্য নির্ভর এবং নিম্ন মিশর ছিল কৃষিনির্ভর সমাজ। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০০ অব্দে মেনেস উচ্চ এবং নিম্ন মিশর একত্রিত করেন। তিনিই মিশরের প্রথম রাজা এবং রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। মিশরীয় বিভিন্ন যুগ সম্পর্কিত ধারণা থাকছে আজকের লেখায়-

মিশরীয় আদি যুগ

মিশরীয় আদি যুগ

আদি রাজবংশীয় যুগ (৩১০০ থেকে ২৬৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)

রাজা মেনেস মিশরের প্রথম ফারাও এর মর্যাদা লাভ করেন। তিনি প্রাচীন মিশরের রাজধানী স্থাপন করেন মেম্ফিসে। পরবর্তীতে এই রাজধানী মহানগরে পরিণত হয়। যা মিশরীয় সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। আদি রাজবংশীয় যুগে মিশরীয় সমাজের মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। রাজত্বের গুরুত্বপূর্ণ আদর্শগুলোও বিকশিত হয়েছিল এই সময়।

প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে রাজা ছিল ঈশ্বরের মতো। তাদের সর্বশক্তিমান দেবতা হুরাসের সঙ্গে রাজার ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে ধারণা ছিল তাদের। নগর সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিশরীয় লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। ছবি বা চিত্র এঁকে তারা মনের ভাব প্রকাশ করত। এটি মূলত চিত্রলিপি ছিল। এই চিত্রলিপিকে ‘হায়ারোগ্লিফিক’ বা পবিত্র অক্ষর বলা হয়।

প্রাচীনতম ‘হায়ারোগ্লিফিক’ এর প্রথম দিকের নিদর্শন আদি রাজবংশীয় যুগের। মূলত প্রথম এবং দ্বিতীয় রাজবংশের রাজত্বকালকে মিশরীয় আদি রাজবংশীয় যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মিশরের আদি রাজবংশীয় যুগে, অন্যান্য সময়কালের মতো বেশিরভাগ জনগণ ছোট ছোট গ্রামে বসবাস করত এবং কৃষিনির্ভর ছিল। মূলত কৃষিই প্রাচীন মিশরীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তাদের প্রধান ফসল ছিল গম এবং বার্লি।

পাথরের গায়ে চিত্রলিপি

পাথরের গায়ে চিত্রলিপি

পুরাতন রাজত্ব (২৬৮৬ থেকে ২১৮১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)

প্রাচীন মিশরীয় তৃতীয় রাজবংশের মাধ্যমে পুরাতন রাজত্বের সময়কালের সূচনালগ্ন। তৃতীয় রাজবংশের শাসনকাল থেকে ষষ্ঠ রাজবংশের শাসনকাল পর্যন্ত এই সময় বিস্তৃত ছিল। প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে এই যুগকে বলা হয় পিরামিডের যুগ বা পিরামিড নির্মাতাদের যুগ। মিশরের বিখ্যাত খুফুর পিরামিড, খাফরে এর পিরামিড, মেনকাউরে এর পিরামিড এই শাসনামলের কীর্তি।

খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৩০ অব্দের দিকে তৃতীয় রাজবংশের রাজা জোসার তার নিজের জন্য স্থপতি, পুরোহিত এবং বৈদ্য ইমহোটেপকে একটি সমাধিসৌধের নকশা তৈরি করতে আদেশ দিয়েছিলেন। ইমহোটেপ ফারাও এর পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করতেন। তার খ্যাতি প্রাচীন মিশরে এতোটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে পরবর্তীকালে তাকে দেবতা হিসেবেও উপাসনা করা হত।

ইমহোটেপ ফারাও জোসার এর আদেশ অনুযায়ী, মেম্ফিসের নিকটবর্তী সাক্কারায় একটি স্টেপ পিরামিড তৈরি করেন। যা বিশ্বের প্রথম অন্যতম পাথরের স্থাপত্য। মিশরীয় পিরামিড স্থাপত্য কায়রোর উপকণ্ঠে গিজায় গ্রেট পিরামিড নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছেছিল। ফারাও খুফু প্রাচীন মিশরীয় রাজত্বের সময়ের বিখ্যাত ফারাও।

প্রাচীন মিশর

প্রাচীন মিশর

তার শাসনকাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২৫৮৯ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৫৬৬ অব্দ পর্যন্ত। ফারাও খুফুর পিরামিডকে পরবর্তীকালে ধ্রুপদী ইতিহাসবিদরা প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে অবিহিত করেন। গিজার মালভূমি অঞ্চলকে তিনি পিরামিড নির্মাণের স্থান হিসেবে নির্বাচন করেন। ১৪৬ দশমিক ৫৯ মিটার উঁচু এই পিরামিড পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পিরামিড হিসেবে স্বীকৃত।

তার আমলের এই বিশাল স্থাপত্যের জন্য ইতিহাসবিদদের অনেকে তাকে অত্যাচারী, নিষ্ঠুর এবং যশলোভী ফারাও হিসেবে উপস্থাপন করেন। তবে এর বিপরীত মতামতও প্রচলিত আছে। কারণ প্রাচীন মিশরের শেষ যুগ পর্যন্ত তার উপাসনা করা হতো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস অনুমান করেছিলেন, ফারাও খুফুর পিরামিড তৈরি করতে ১০ হাজার শ্রমিকের ২০ বছর সময় লেগেছিল।

গিজায় আরো দুটি পিরামিড নির্মিত হয়েছিল। এ দুটি ছিল ফারাও খুফুর উত্তরসূরীদের। এর মধ্যে একটি ফারাও খাফরে এর পিরামিড। তার শাসনকাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২৫৫৮ অব্দ থেকে ২৫৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। অন্যটি ফারাও মেনকাউরে এর। তার শাসনকাল খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২৫৩২ থেকে ২৫০৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত।

পিরামিড তৈরি শুরু হয় এই সময়কালে

পিরামিড তৈরি শুরু হয় এই সময়কালে

এই যুগের বিশালাকার পিরামিড এবং মন্দির দেখে ফারাওদের ক্ষমতাও অনুমান করা যায়। পুরাতন রাজত্বের সময় সে যুগের মিশরীয় নির্মাণ কৌশল এবং শিল্পের ক্রমবিবর্তন যেমন স্পষ্ট হয় তেমনি তাদের মৃত্যু কেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস সম্পর্কে জানা যায়। ইতিহাসবিদদের ধারণা, এই যুগে ফারাওরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং জীবন্ত দেবতা হিসেবে পূজিত হতে থাকেন। প্রজাদের সব সেবা এবং সম্পত্তির দাবিদারও ফারাও ছিলেন।

তৃতীয় এবং চতুর্থ রাজবংশের সময় প্রাচীন মিশর শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বর্ণযুগে পৌঁছেছিল। সেসময় ফারাওরা পরম ক্ষমতার অধিকারী ছিল এবং স্থিতিশীল কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজ্য গুরুতর কোনো বিদেশি হুমকির সম্মুখীন হয়নি। বরং তারা লিবিয়ার মতো দূরবর্তী দেশেও সফল সামরিক অভিযান পরিচালনা করে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল।

গ্রেট পিরামিড

গ্রেট পিরামিড

পঞ্চম এবং ষষ্ঠ রাজবংশের সময় প্রাচীন মিশরের স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছিল। অর্থনৈতিক দুর্বলতার জন্য আংশিকভাবে দায়ী ছিল পিরামিড নির্মাণের বিশাল ব্যয়ভার। ফারাওদের পরম ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছিল। রাজ্যে অভিজাত শ্রেণি এবং সূর্যদেবতা ‘রে’ এর অনুসারী যাজকদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল এসময়।

ষষ্ঠ রাজবংশের দ্বিতীয় পেপি প্রায় ৯৪ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মূলত ফারাও দ্বিতীয় পেপির মৃত্যুর পর মিশরীয় পুরাতন রাজত্বের সময়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপরে আরো রয়েছে প্রথম মধ্যবর্তী সময়কাল, দ্বাদশ রাজবংশের মধ্যবর্তী রাজত্বকাল, দ্বিতীয় মধ্যবর্তী রাজত্বকাল, নতুন সময়ের মিশর, তৃতীয় মধ্যবর্তী সময়কালসহ মিশরীয় সভ্যতার শেষ পর্যায় থেকে আলেকজান্ডারের বিজয় পর্যন্তকাল। এসব নিয়ে বিস্তারিত থাকছে দ্বিতীয় পর্বে। ডেইলি বাংলাদেশের সঙ্গেই থাকুন।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.