267617

দোকানদার ছাড়াই চলছে ভিন্ন দোকান, পণ্য নিয়ে ক্রেতা রেখে দেয় টাকা!

‘আমি যদি কাউকে বিশ্বাস না করি তবে সে কেন আমাকে বিশ্বাস করবে?’ এমনই প্রশ্ন সবার উদ্দেশ্যে ছুড়েছেন ভিন্ন রকম দোকানের মালিক হামিদুর রহমান শিপন। আসলেই, বিশ্বাস তো সোনার চেয়েও দামী। আসলে দাম দিয়েও বিশ্বাস কেনা যায় না। বিশ্বাস অর্জন করতে হয় কর্মের মাধ্যমে। আর তা কর্মের মাধ্যমেই দেখিয়ে দিয়েছেন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার হামিদুর রহমান শিপন।

বর্তমানে যেখানে পরিবারের এক সদস্য আরেক সদস্যকে বিশ্বাস করে না, সেখানে শিপন দোকানদারবিহীন ব্যবসা করে দৃষ্টান্ত গড়েছেন। শিপন ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, আমার দোকান সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে। দোকানে আমি থাকি না। দোকান খুলেই আমি ট্রেনে চড়ে মাল ফেরি করতে বেরিয়ে যাই। এদিকে ক্রেতারা আমার দোকানে ঢুকে পছন্দ ও দাম অনুযায়ী মাল কিনে টাকা বক্সে রেখে যান। সন্ধ্যায় এসে আমি টাকার বাক্স খুলি। কখনো মাল বা টাকা কম পড়েনি। এই হলো বিশ্বাসের প্রকৃত উদাহরণ।

কুমারখালী উপজেলার রেল স্টেশনের সঙ্গেই হামিদুর রহমান শিপনের ‘ভিন্ন রকম দোকান’। সেখানে তিনি তোয়ালে, গামছা, হাজী রুমাল, ছোট রুমাল, লুঙ্গি, টুপি ইত্যাদি বিক্রি করে থাকেন। তার দোকানের প্রত্যেকটি জিনিসের গায়ে নির্ধারিত মূল্য লেখা থাকে। ক্রেতারা সেই দাম দিয়ে পণ্যটি নিয়েই পাশে রাখা টাকার বক্সে মূল্য পরিশোধ করেন। যদিও তার দোকানে মাল অনেক কম। অর্থের অভাবে দোকানের অর্ধাংশ প্রায় ফাঁকা।

এদিকে শিপন দোকান খুলেই বেরিয়ে পড়েন হকারি করতে। তার হাতে থাকে কিছু লুঙ্গি, ঘাড়ের উপরে গামছা ও কাঁধের একটি ব্যাগে স্বল্প কিছু মাল নিয়ে শুরু করেন হকারি। ট্রেনে চড়ে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে হকারি করেন তিনি। আর অন্যদিকে ভিন্ন রকম দোকানেও চলে বেচাকেনা।

দোকানদারবিহীন দোকান

দোকানদারবিহীন দোকান

দোকান থাকতেও শিপন কেন হকারি করেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হকারি করেই আমি বরাবর পেট চালিয়ে আসছি। আমার মূল পেশা হলো হকারি করা। বিগত পাঁচ বছর আগে আমি ‘ভিন্ন রকম দোকান’ শুরু করি। তবে সারাদিন দোকানে বসে থেকে ব্যবসা করার বিষয়টি আমার মনে ধরেনি। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দোনকানদারবিহীন দোকান শুরু করলে কেমন হয়? অতঃপর তাই শুরু করলাম। আসলে হকারি করাই আমার অভ্যাস, দোকানে বসে থাকতে ভালোও লাগে না। এছাড়াও শুধু দোকানে বসে থাকলে আমার পরিবারের খরচও জোগাতে পারব না।

বর্তমানে পুরো বাংলাদেশ জানে শিপনের এই মহানুভবতার কথা। তবে নিজ এলাকার মানুষই তার এই উদ্যোগ প্রথমে মেনে নিতে চায়নি। সবাই শিপনকে পাগলের তকমা দিয়ে বলেছিল, লোকটি পাগল হয়ে গেছে নাকি! এই যুগে এসে কেউ এভাবে দোকানদারবিহীন দোকান করে! লোক কথায় কখনো কান দেননি শিপন।

তিনি ডেইলি বাংলাদেশকে আরো বলেন, অনেকেই প্রথমে আমাকে পাগল বলে জাহির করেছিল। আমি মানুষকে বিশ্বাস করে দোকনদারবিহীন দোকান করেছি, একে কারো সহযোগিতা পাইনি, উল্টো সবাই আমাকে নিয়ে উপহাস করেছে। বলেছে পাগলের মতো বুদ্ধি, এই ব্যবসা কখনো টিকবে না, আজ আছে কাল নাই ইত্যাদি। মানুষের উপহাসই আমার মনোবলকে আরো দৃঢ় করেছে।

এমন ব্যবসায়ের মাধ্যমে বর্তমানে শিপন এক নজির সৃষ্টি করেছেন। তার এই উদ্যোগে বর্তমানে সেই এলাকার লোকেরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অথচ একসময় তারা শিপনের এই কাজকে ভালোভাবে নেয়নি। শিপন বলেন, আমাকে দেখে অনেকেই এখন প্রশংসা করেন। সত্যিই আমার ভালো লাগে। আমার মনে হয়, বর্তমানে মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব রয়েছে। আর এ কারণেই এতো দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও মতোবিরোধ তৈরি হয়।

ভিন্ন রকম দোকান

ভিন্ন রকম দোকান

বর্তমানে শিপনের দৈনিক উপার্জন হয় ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকার মতো। তবে করোনা পরিস্থিতিতে বিগত চার মাস সে হকারি করতে পারেনি। অন্যদিকে দোকানেও তেমন বিক্রি নেই। তবুও থেমে নেই সে। শুধু যে শিপন এমন দোকান করেই মানুষের আলোচনায় এসেছেন তা কিন্তু নয়। মানুষের বিভিন্ন সেবামূলক কর্মে তিনি সর্বদা নিয়োজিত থাকেন। এই করোনাকালে তিনি ফেরি করে মাস্ক বিক্রি করেছেন। যারা হতদরিদ্র তাদের সুরক্ষার জন্য বিনামূল্যে মাস্ক পরিয়ে দিয়েছেন নিজ হাতে। সেই সঙ্গে বিনামূল্যে অনেকের হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজারও মাখিয়ে দিয়েছেন।

এমনকি শিপন তার ভিন্ন রকম দোকানে বিনামূল্যে খাবার পানির ব্যবস্থাও রেখেছে। স্টেশনে থাকা বিভিন্ন মানুষের তেষ্টা নিবারণের জন্য তার এই প্রচেষ্টা। বর্তমানে যেখানে এক গ্লাস পানিও কিনে খেতে হয় সেখানে তার মতো মহানুভব মানুষই বা কয়জন আছে যে বিনামূল্যে পানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে।

তার উদারতা ও মহানুভবতার উদাহরণ এখানেই শেষ নয়। যখন তিনি ট্রেনে চড়ে হকারি করেন তখন বিভিন্ন মানুষের মালের বোঝাও টেনে দেন বিনামূল্যে। বয়স্ক মানুষদের সযত্নে ট্রেনে উঠতে ও নামতেও সাহায্য করেন পরোপকারী শিপন। এমনকি নিজ এলাকার কারো মৃত্যু সংবাদ পেলে নিজ উদ্যোগে বিনামূল্যে শোক সংবাদ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। ভ্যানে করে মৃতের পরিবার থেকে অনুমতি নিয়ে এই কাজটি করে থাকেন শিপন।

দোকানদারবিহীন ‘ভিন্ন রকম দোকান’ এর প্রতিষ্ঠাতা শিপন একজন হতদরিদ্র মানুষ। তবুও কখনো তিনি কারো কাছে হাত পাতেননি। নিজের পরিশ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে আজো দৈনিক তিনি লড়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে শিপন জানান, তার তিনটি সন্তান রয়েছে। সে ও তার স্ত্রীসহ সংসারে মোট পাঁচ জন। সবারই ভরণ-পষোণের দায়িত্ব তার উপর। হকারি করে তিনি যে অর্থ উপার্জন করেন সেটা আর দোকানের অর্থ মিলিয়েই তার সংসার চলে। বড় দুই সন্তানকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। ছোট মেয়ের বয়স মাত্র তিন বছর।

সারাদিন হকারি শেষ করে ঘরে এসেও দম ফেলার ফুরসত নেই শিপনের। তখন তিনি পাইকারি দামে কিনে আনা তোয়ালে, লুঙ্গি সেলাই করেন। রুমাল তৈরি করেন। আবার সকালে সেগুলো নিয়ে দোকানে রেখে দেন পণ্যের গায়ে মূল্য লিখে। এরপর আরেকটি দিনের শুরু, চলমান ট্রেনের মতো চলতেই থাকে শিপনের জীবন। দোকানের সামনে থেকে সে উঠে পড়ে পরের গন্তব্য কিংবা আরো দূরের কোনো স্টেশনের উদ্দেশ্যে। চলমান ট্রেনের মধ্যে গামছা, তোয়ালে, রুমাল নিয়ে হকারি করে সে। অতঃপর আবার ফিরতি ট্রেনে উঠে চলে আসে তার ভিন্ন রকম দোকানে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.