267428

আজব এক গোলাকার যান! এতে চড়েই বিশ্ব প্রথম সমুদ্রতলে যায়

সমুদ্রতলের জীববৈচিত্র্য কতই না মনোমুগ্ধকর। বাহারি রঙের সামুদ্রিক প্রাণী সেই সঙ্গে শৈবালের বিচরণভূমি হলো সমুদ্র সৈকতের তলদেশ। বর্তমানে আমরা সবাই বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সহজেই সমুদ্রতলে প্রবেশ করতে পারি।

আবার সমুদ্রতল দেখার ইচ্ছে হলে গুগলে সার্চ দিলেই হাজারো ছবি ও ভিডিও আমাদের সামনে চলে আসে। তবে কখনো কি ভেবে দেখেছেন, অতীতে সমুদ্রতল সম্পর্কে মানুষ কতটুকু জানত? এই বিষয়টি নিয়েই আজকের লেখা-

১৯৩২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বিকেলে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সর্বত্র শ্রোতাদের কান ছিল রেডিওতে। তারা টানটান উত্তেজনা সহকারে এক সরাসরি সম্প্রচার শুনছিলেন। ওই লাইভ অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছিল সমুদ্র পৃষ্ঠের কয়েকশ ফুট নিচ থেকে। একটি ছোট স্টিলের গোলকের ভিতর থেকে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হচ্ছিল।

সামুদ্রিক যানটি

সামুদ্রিক যানটি

এর ভিতরে ছিলেন প্রকৃতিবিদ উইলিয়াম বিব এবং আবিষ্কারক ওটিস বার্টন, যিনি এই ডিভাইসটি আবিষ্কার করেছিলেন। বেল ল্যাবরেটরিজ এর সরবরাহকৃত একটি টেলিফোন সিস্টেমের মাধ্যমে বিবে সমুদ্রের নিচের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। বিব এবং বার্টন ১৫০০ ফুট গভীরে গিয়েছিলেন তাদের আবিষ্কৃত ডিভাইসটির মাধ্যমে। যা সেময়ের সমুদ্রের গভীরতম স্থনে যাওয়ার রেকর্ড ছিল।

এ ঘটনার পূর্ব পর্যন্ত ডাইভিং স্যুট পরে ৫০০ ফুট পর্যন্ত গভীরে যাওয়ার রেকর্ড ছিল। একটি সাধারণ সাবমেরিন মার ৪০০ ফুট পর্যন্ত গভীরে যেতে পারত। উইলিয়াম বিব সমুদ্রের গভীরে গিয়ে সেখানকার প্রাণীদের রহস্যময় জীবন পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলেন। ততদিন পর্যন্ত সমুদ্রের তল থেকে সরাসরি প্রাণীদের জীবন পর্যবেক্ষণের নজির ছিল না এবং তাদের মূল পরিবেশেও কেউ দেখেনি।

বিব এবং বার্টনের সমুদ্রযানটি বাথিস্ফিয়ার নামে পরিচিত। এই গোলকটির উচ্চতা ছিল প্রায় পাঁচ ফুট। এর ভিতরে বিভিন্ন ধরণের বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম ছিল। উপরের স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য একটি টেলিফোন, বৈদ্যুতিক বাতি, অক্সিজেনের বোতল রাখা হয়েছিল। ভিতরে থাকা ব্যক্তিদের নিঃসৃত কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের সোডা চুন এবং ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডের ট্রে রাখা হয়েছিল।

যানটি তিন হাজার ফুট দীর্ঘ স্টিলের তারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল

যানটি তিন হাজার ফুট দীর্ঘ স্টিলের তারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল

সমুদ্রযানটির ভিতর থেকে বাইরের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাথিস্ফিয়ারে ছোট গোলাকার জানালা ছিল। এতে তিন ইঞ্চি পুরু ফিউজড কোয়ার্টজ লাগানো হয়েছিল। জানালার উপরে স্পটলাইট স্থাপন করা হয়েছিল। যানটির ভিতরে প্রবেশ করার জন্য ছোট একটি প্রবেশ দ্বার রাখা হয়েছিল। বিব এবং বার্টন বারমুডা উপকূলে বাথিস্ফিয়ারে প্রথম ১৯৩০ সালে ২৭ মে পরীক্ষামূলক সমুদ্রের তলদেশে ভ্রমণ করেন।

বাথিস্ফিয়ারটি তিন হাজার ফুট দীর্ঘ একটি স্টিলের তারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং একটি জাহাজ থেকে সমুদ্রে নামানো হয়েছিল। পরবর্তী চার বছরে বিব এবং বার্টন ৩০ বারেরও বেশি সমুদ্র তলদেশে ভ্রমণ করেছিলেন। এর ঝুঁকিও কম ছিল না। বাথিস্ফিয়ারে ছোট একটি ছিদ্র হলেও বড় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ছিল। বিব এবং বার্টন এই ঝুঁকি নিয়েই সমুদ্রতলের বাস্তুতন্ত্র পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। যা আগে কেউ কখন দেখেনি।

উইলিয়াম বিব প্রথম ব্যক্তি, যিনি পর্যবেক্ষণ করেন সমুদ্রের গভীরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের আলো কীভাবে ধীরে ধীরে তার রং হারিয়ে ফেলে। তিনি বাথিস্ফিয়ারের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘হাফ মাইল ডাউন’ বইটিতে লিখেছেন, নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে সবুজ বর্ণহীনভাবে বিবর্ণ হয়ে যায়। আর ২০০ ফুট গভীরে যাওয়ার পর বলা প্রায় অসম্ভব যে পানি সবুজ-নীল নাকি নীল-সবুজ।

তারা দুজনই সমুদ্রের তলদেশে এই যানে চড়ে গিয়েছিল

তারা দুজনই সমুদ্রের তলদেশে এই যানে চড়ে গিয়েছিল

বিব বাইতিতে আরো লিখেছেন, এক হাজার ফুট গভীরের পারিপার্শ্বিক অবস্থা পরিদর্শন করে পানির রং কালো-নীল বা কোলো ধূসর-নীল নাম দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আরো গভীরে নীল রং ক্রমাগত শোষিত হয়ে কালো রঙে রূপান্তিরত হয়। উইলিয়াম বিবের সমুদ্রতলের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর ১৯৩১ সালের জুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল একটি নিবন্ধ।

বিবের পর্যবেক্ষণ এবং বর্ণনা শুনে প্রকৃতি বিষয়ক চিত্র শিল্পী এসল বোস্টলম্যান সমুদ্র তলদেশের প্রাণীদের বস্তব জীবনের নিখুঁত চিত্র এঁকেছিলেন। যা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর নিবন্ধের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। এর বহু বছর পরের পানির নিচের ফটোগ্রাফির দ্বারা এই বিষয়ে আরো বিস্তৃতভাবে জানা যায়। অনুসন্ধানের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য বিব এবং বার্টন ‘এনবিসি’ সম্প্রচার সংস্থার সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন।

চুক্তি অনুযায়ী তারা আধা মাইল সমুদ্রের গভীরে গিয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণ করা অভিজ্ঞতা শ্রোতাদের সরাসরি বর্ণনা করে শুনাতে চেয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হওয়ার দিন সাগর খুবই উত্তাল ছিল। তবে প্রোগ্রামটি নির্দিষ্ট সময়েই শুরু হয়। ফলে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে বিব এবং বার্টন প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই সমুদ্র তলদেশে গিয়ে সমুদ্রযানের টেলিফোনের মাধ্যমে সেখানকার চিত্র বর্ণনা করেছিলেন।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক মিউজিয়ামে এই যানের একটি কপি রাখা হয়েছে

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক মিউজিয়ামে এই যানের একটি কপি রাখা হয়েছে

তিন হাজার ফুটের একটি তারের মাধ্যমে তাদের কথা উপরের জাহাজের ট্রান্সমিটারে এসে পৌঁছানোর পর সেখান থেকে সারা দেশে সম্প্রচারিত হয়েছিল। প্রোগ্রামটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিব তাদেরকে উপরে উঠিয়ে আনতে বলেছিলেন। তবে বাথিস্ফিয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত ইস্পাতের ক্যাবল টান দেয়ার পর এটি জোরে দুলতে থাকে ফলে দুজনই আহত হন। তবে তাদের সমুদ্র গভীরে যাওয়ার ইচ্ছা যেন আরো প্রাগাঢ় হয়ে ওঠে।

১৯৩৪ সালের ১১ আগস্ট তারা দুজন ২৫১০ ফুট গভীরে পৌঁছেছিলেন। ঠিক এর চারদিন পর তারা ৩০২৮ গভীরে গিয়েছিলেন। আর প্রায় ১৫ বছর পর বার্টন ৪৫০০ ফুট গভীরে গিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছিলেন। প্রযুক্তি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাথিস্ফিয়ারের ব্যবহার অপ্রচলিত হয়ে যায় তবে এটি সমুদ্রতলদেশের বাস্তুতন্ত্র পর্যবেক্ষণের অগ্রপথিক ছিল।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.