267320

টিনের টং বাড়িতেই খুশি বিক্রমপুরবাসী

ইট পাথরের শহরে উঁচু দালানের ওপারে আকাশ যেন এখন স্মৃতি। গ্রামেও এখন সেই টিনের ঘর আর দেখা যায় না বললেই চলে। সেখানেও লেগেছে শহুরে বাতাস। ইট সুরকির দালানেই যেন সব সুখ তাদের।

এখানেও আজকাল শহরের মতো পাশের বাড়িতে কে থাকছে দেখা হয় না মাসের পর মাস। দালান ঘরের একেক তলা যেন এখন সম্মান আর মর্যাদার পরিমাণ বহন করে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ নতুন প্রজন্মের কাছে যেন এক রূপকথার গল্প।

তবে এর পুরোপুরি ব্যতিক্রম বিক্রমপুরের বাসিন্দারা। শত শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য এখনো লালন করে যাচ্ছেন তারা। এখানকার ঘরগুলো দেখে প্রথমে কিছুটা নাক শিটকাবেন বৈকি! তবে খানিক পরেই রাজ্যের বিস্ময় আপনার চোখে। কেননা নান্দনিক এই সব দুই তিন তলা বাড়িগুলো তৈরি করা কাঠ আর ঢেউটিন দিয়ে। ভাবছেন এদের এখানে কি আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি এখনো? আসলে বংশপরম্পরায় ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তারা।

বিক্রমপুরের ভৌগলিক অস্তিত্ব সর্বশেষ ছিল মোগল আমলের পরগণা হিসেবে। এরপর সরকা‌রি কাগজ কলমে এর নাম নেই কোথাও। বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত হয়েছে এটি। তবে এখনো এখানকার মানুষ নিজেদের বিক্রমপুরের বাসিন্দা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান আর পুরনো ঐতিহ্যের শহর বিক্রমপুর সবারই কমবেশি চেনা।

টং ঘর

টং ঘর

এখানকার বসতি এলাকায় ঢুকলে চোখে পড়বে কাঠের ফ্রেমের উপর ঢেউটিনের বাহারি সব বাড়ি ঘর। দোচালা থেকে শুরু করে আটচালা ষোল চালার বাহারি  ডিজাইনের সব বাড়ি! দুই থেকে আড়াই ফুট ফাঁকা রেখে ভুমি স্তর থেকে উঁচুতে কাঠের তৈরি প্রতিটি ঘরের মেঝে। বেশিরভাগই দোতলা বাড়ি। তবে তিনতলাও আছে কিছু।ডোবার কিনারে সরাসরি নীচু স্তর থেকে আট দশ ফুট উঁচুতেও করা হয়েছে বাড়ি। বাড়িতে আরোহণের জন্য পরিস্থিতি ভেদে কাঠের সেতু/ কাঠের ধাপ অথবা পাকা ধাপ। ডোবা বা নিচু এই এলাকায় একসময় তৈরী করা হতো খুঁটির উপর ভর করা কাঠের মেঝের টং আকৃতির ঘর। এগুলো আবার একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় চাইলেই সরিয়ে নেয়া যায়।

এখানকার বাড়িগুলোর কাঠের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে টিনের চালের ঝুম বৃষ্টির মোহনীয় সুর আপনাকে এনে দেবে স্বর্গীয় সুখ। বর্ষায় পানি ওঠা ঠেকানো ছাড়াও নদী ভাঙ্গনের সময় দ্রুত সরিয়ে নেয়া হয় ঘরগুলো। এজন্য এর নামই হয়েছে টং থেকে টঙ্গি বাড়ি। যা বর্তমানে মুন্সিগঞ্জের একটি উপজেলা। এখানকার শ্রীনগর আর লৌহজং এলাকায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এধরনের বাড়িগুলো।

আগের মতো পানি এখন আর হয় না, প্রয়োজন ফুরিয়েছে ভাসমান ঘরের। তারপরও ঐতিহ্যের খাতিরে তা এখন রূপান্তরিত হয়েছে সৌখিনতায়। এসব বাড়ির একেকটি তৈরি করতে পাঁচ থেকে বিশ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। অবশ্য ঘরের আয়তন এবং নকশাভেদে তারতম্য হয়। বাড়ির ভেতরে রয়েছে আধুনিকতার সব অনুষঙ্গ। অনেকের বাড়িতে ঢুকলেই দেখা যাবে অত্যাধুনিক টাইলসের ব্যবহার।

বিভিন্ন টং ঘর

বিভিন্ন টং ঘর

কারুকাজ শুধু কাঠেই নয়, টিনের উপর কারুকাজ করেও ছাদ হতে রাখা হয় ঝুলন্ত বেষ্টনী। নজর কাড়ে নকশা করা থাম আর দরজাও। এ ধরণের দৃষ্টিনন্দন ঘর তৈরির নৈপুণ্য পরিশিলীত হয়ে রূপ পেয়েছে শিল্পে। স্বল্পতম জায়গায় সর্বোচ্চ সংখ্যক ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের আবাস স্থল এই বিক্রমপুর। অতি স্বচ্ছন্দে নির্মাণ করতে পারেন অত্যাধুনিক ঘর বাড়ি।পরম মমতায় তারা আকড়ে রেখেছেন বংশ পরম্পরায় চলে আসা ঐতিহ্য। রেখে দিয়েছেন সেই কাঠের ফ্রেমে ঢেউটিনের কাঠের পাটাতনের ঘর বাড়ি। নকশাকারের পাকা হাতে নিরেট কাঠ আর টিন রূপ নেয় শৈল্পিক আবাসে। একটি ঘর ৪ থেকে ৫ জন মিস্ত্রি মিলে বানাতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ দিন।

এই এলাকায় কিন্তু এই ঘরের বাজারও বসে। বিক্রমপুরের ঘরের বাজার বলতে কিছুটা খোলা জায়গায় সারি সারি ঘর সাজিয়ে বিক্রেতা অপেক্ষা করেন। একেকটা একেক রকম। নমুনা রেখে দেয়া হয়েছে তৈরী করে। এখান থেকে ক্রেতারা কিনে নেন তার পছন্দমতো ঘর।

এর থেকেও বিলাসবহুল দ্বিতল, তিন তলা বিলাস বহুল বাড়ির জন্য বাড়ির মাপসহ অর্ডার দিতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ান্তে সরবরাহ করা হয় ক্রেতার রুচি ও পছন্দ মাফিক। প্রতিটি অংশ খুলে স্থাপন করে দিয়ে আসা হয় ক্রেতার বাড়িতে। বিক্রয়ের জন্য সারা বছর প্রদর্শনী হিসেবে নির্মিত ঘর রেখে দেয়ার এমন নজির অন্য কোথাও আর নেই।

তিন তলা টিনের ঘর

তিন তলা টিনের ঘর

বর্তমানে অনলাইনেও পাবেন এই ঘর কেনার সুবিধা। আবার নিজের পছন্দ মতো ডিজাইন দিলে তারা সেই মতো করে দিবে আপনার ঘরটি। এখানকার টং ঘরের বাসিন্দারা জানান, টিন আর কাঠের এই বাড়ির মর্যাদা তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি।পর্যাপ্ত আলো বাতাস পাওয়া যায় এই ঘরের ভেতর। আবহাওয়াভেদে ঘর ঠাণ্ডা বা গরম থাকে। গরমের সময়টা ঘরের ভেতর শীতল আর শীতের সময় থাকে উষ্ণ। এছাড়াও নদী ভাঙন এলাকা হওয়ায় এই ঘরের কদর রয়েছে এখনো।

বর্তমানে বুয়েটসহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোড় স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা এসব ঘর নিয়ে সার্ভে করছেন। তৈরি করছেন নতুন নতুন ডিজাইন। অনেকে আবার পরিবার পরিজন নিয়ে পিকনিক করতে যান এই জায়গাগুলোতে। সেখানকার মানুষেরাও এতে আনন্দ পান।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.